দুপুর বেলা আমাদের ছাদে একটা চোর ধরা পড়ল।
আমি খবরের কাগজ নিয়ে রোদে বসেছিলাম। ছুটির দিনে আরাম করে কাগজ পড়ব–হৈ চৈ শুনে ছাদে গেলাম।
সেখানে শিশুদের একটা জটলা। জটলার মাঝখানে সুখীসুখী চেহারার একজন লোক। গোল গোল মুখ। সুন্দর করে চুল আচড়ানো। পরনে লুঙ্গী, সাদা। পাঞ্জাবী। আমাদের কাজের ছেলেটি শক্ত করে লোকটির হাত ধরে আছে এবং কিছুক্ষণ পর পর ভাঙ্গা গলায় চেঁচাচ্ছে–চোর! কাপড় চোর!
আমাকে দেখে সেই চোর মধুর স্বরে বলল, ভাইসাব ভাল আছেন?
আমি স্তম্ভিত। বলে কি এই লোক। আমি ভাল করে তাকালাম। লোকটি পান চিবুচ্ছে। পান চিবৃনোর কারণেই হয়ত লোকটির মধ্যে শান্তি শান্তি ভাব। এ রকম প্রশান্ত চেহারার কাউকে চট করে তুই বলা যায় না তবু চোরদের তুই করে বলাই নিয়ম। কাজেই আমি যথাসম্ভব কর্কশ গলায় বললাম, তুই ছাদে কি করছিস?
সে হাসি মুখে বলল, চুরি করতে আসছিলাম ভাইজান।
আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। চোর কখনো বলে না চুরি করতে এসেছিল।
তাহলে কি এই লোকটি চোর নয়? আমি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়ে বললাম (এইবার তুমি সম্বোধনে)
: কি চুরি করতে এসেছ?
: শাড়ি লুঙ্গী এই সব। বাচ্চা কাচ্চার কাপড় আমি নেই না ভাইসাব।
: নাও না কেন?
: মার্কেট নাই।
: বাড়ি কোথায় তোমার?
: নেত্রকোনা, গ্রাম ধুপখালি, বারহাট্টা।
: ঢাকায় থাক কোথায়?
মিরপুর দুই নম্বর সেকশন। সদর রাস্তার পাশে গ্রীন ফার্মেসী। গ্রীন ফার্মেসীর পিছনে। আমার নাম মোঃ ইসমাইল। গ্রীন ফার্মেসীতে আমার নাম জিজ্ঞেস করলে বাসা দেখায়ে দিবে।
আমি আরো ধাঁধায় পড়ে গেলাম–নাম ঠিকানা সব বলে দিচ্ছে ব্যাপারটা কি?
চোর এইবার উদাস গলায় বলল, মারধোর যা কবার করে ফেলেন। বাসায় যাব।
: মারধোর করব?
: তাতো ভাইসাব করতেই হয়। চোর ধরলে চোররে তো কেউ চা বিস্কুট খাওয়ায় না।
এলেবেলের পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন এ জাতীয় চোরদের মারধোর কর। অত্যন্ত কঠিন। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। শুধু ছেড়ে দিলাম বলাটা ঠিক হবে না। চোরকে টোষ্ট দিয়ে এক কাপ চাও খাওয়ালাম। সে যেমন হাসি মুখে ধরা পড়েছিল তেমনি হাসি মুখে বিদেয় হল।
এখন কথা হচ্ছে চোরকে আমি চা বিস্কুট খাইয়ে বিয়ে করলাম কেন? সে আমার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করেছে বলেই কি? এই অদ্ভুত আচরণটা কি তার একটা কৌশল? নাকি লোকটার মাথা খারাপ। ভদ্রলোকের মধ্যে প্রচুর মাথা খারাপ আছে, চোরদের মধ্যে থাকবে না কেন?
আর এটা যদি তার আত্মরক্ষার কৌশল হয় তাহলে চমৎকার কৌশল স্বীকার না করে উপায় নেই। অন্যকে বোকা বানানোর সুন্দর কৌশল। একজন রিকশাওয়ালার গল্প বলি–গুলিস্তানে উঠেছি, যাব ভূতের গলি। ভাড়া চাইল তিন টাকা। আমি বেশ খানিকটা দ্বিধার ভাব নিয়েই রিকশায় উঠলাম। যেখানে আট টাকা ভাড়া হওয়া উচিত সেখানে তিন টাকা চাচ্ছে, রহস্যটা কি? কোন রকম রহস্য টের পাওয়া গেল না। তিন টাকা দেয়া মাত্র রিকসাওয়ালা দেখি চলে যাচ্ছে। আমি ডাকলাম, অবাক হয়েই বললাম, এত কম ভাড়া নিচ্ছ ব্যাপারটা কি?
রিক্সাওয়ালা করুণ গলায় বলল, পরশু আসছি ঢাকা শহর। ভাড়া কত জানি না। যা পাই তাই নেই। কেউ কেউ বেশী দেয়। আমি মনে মনে কই আলহামদুলিল্লাহ। কেউ কেউ আমারে ঠকায়। আমি বেজার হই না। সবই আল্লাহর হুকুম।
আমি মানিব্যাগ থেকে দশটা টাকা বের করে দিলাম। যখন রিকসাওয়ালার সততায় পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছি তখন চট করে মনে হল, যে লোক পরশু ঢাকা শহরে এসেছে সে গুলিস্তান থেকে ভূতের গলির মত জায়গায় চলে এল কিভাবে? রিকসাওয়ালা কি আমাকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে গেল?
মুশকিল হচ্ছে কি, এরকম বোকা আমরা হরদম বনছি। এই যুগের মন্ত্র হচ্ছে, কে কাকে কতটা বোকা বানাতে পারে। নাট্যকার নিদারুণ করুণ গল্প লিখে চেষ্টা করছেন দর্শকদের কাঁদিয়ে বোকা বানাতে। দর্শকরা সেই করুণ রসের নাটক দেখে হা হা করে হেসে নাট্যকারকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছেন। রাজনীতিবিদ চেষ্টা করছেন জনগণকে বোকা বানাতে, জনগণ চেষ্টা করছেন রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলতে। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া বন্যার কথাটা ধরা যাক। কেন বন্যা হল সেই সম্পর্কে নানান রকম থিওরী। প্রতিটি থিওরী একদলকে বোকা বানানোর জন্যে তৈরী। যেমন–
(ক) বন্যা হয়েছে কারণ আগের সরকার অপরিকল্পিতভাবে খাল কেটেছেন। নদী ড্রেজিং করাননি। (এই থিওরি বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার জন্যে)।
(খ) বন্যার মূল কারণ পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র। তাদের ফারাক্কা বাঁধ। এই থিওরি খুব সম্ভব শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলবার জন্যে, কারণ তিনি ইদানিং খুব বলে বেড়াচ্ছেন বন্যার সঙ্গে ইণ্ডিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। কেন বলছেন কে জানে–হয়ত কাউকে বোকা বানাতে চান।
(গ) বন্যা হচ্ছে আল্লাহর গজব। আল্লাহ যেমন ফেরাউনকে শায়েস্তা করবার জন্যে নূহ নবীর সময়ে মহাপ্লাবন দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বন্যাও তাই।
মন্তব্যটি এরশাদ সাহেবের জনৈক মন্ত্রীর। মন্ত্রী ফেরাউন বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন কে জানে। যদি এরশাদ সাহেবকে বোঝাতে চান তাহলে বলতে হবে তিনি বোকা বানাতে চাচ্ছেন খোদ রাষ্ট্রপ্রধানকেই। তবে আমার তা মনে হয় না। এরকম কুটবুদ্ধির কাউকে এরশাদ সাহেব মন্ত্রী বানাবেন না।
(ঘ) বন্যার মূল কারণ আমেরিকা। তাদের কারণেই বিশ্বজোড়া পরিবেশ দূষণ হয়েছে। যার কারণে এই ভয়াবহ বন্যা।
বামপন্থীদের কথা। তারা সম্ভবত নিজেদেরকেই বোকা বানাতে চাচ্ছেন।
আমার এলেবেলে শ্রেণীর লেখাগুলির মূল উদ্দেশ্যও কিন্তু তাই। পাঠকদের বোকা বানানো। প্রথমে চোর নিয়ে অবিশ্বাস্য একটি গল্প ফাঁদলাম, তার সঙ্গে রিকসাওয়ালাকে নিয়ে গল্পটি (এটি সত্যি গল্প জুড়ে দিলাম। কারণ মিথ্যা সত্যির সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করতে হয়, নয়ত তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এর পর পরই বোকা বানানো প্রসঙ্গ এনে কিছু আঁতেল জাতীয় কথাবার্তা বলা হল এই আশায় যাতে কিছু পাঠক মনে করেন আরে এই লোকের এ্যানালিসিস তো। খারাপ না।
অবশ্যি পাঠকরা (যেহেতু তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি লেখকদের চেয়ে উচ্চস্তরের) কি করবেন তাও আমি জানি। এলেবেলে শেষ করে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে লেখকের উদ্দেশ্যে দুঅক্ষরের একটি গালি দেবেন, যে গালিতে আমার বোনের সঙ্গে পাঠকের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হবে।
তা নিয়ে আমি ঠিক বিচলিত নই, কারণ বিচলিত হবার কিছু নেই, যুগটাই এমন।
“এলেবেলে- ২য় পর্ব” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ