ডিসট্রিক্ট দায়রা জজ নুরুল হক সাহেবের বুকে অনেকক্ষণ হলো কফ জমেছে। কফ সবার জন্যে হালকাভাবে খুকখুক করেছেন। তাতে লাভ হচ্ছে না। তাকে শব্দ করে কাশতে হবে। তিনি কিছুটা ব্ৰিত বোধ করছেন। আদালতে বিচার চলছে। রাষ্ট্র বনাম আলাউদ্দিন মামলা। আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ। আলাউদ্দিনকে এই মুহূর্তে পাবলিক প্রসিকিউটর প্রশ্ন করছেন। সবার দৃষ্টি সেই দিকে। এখন তিনি যদি বিকট শব্দে কাশেন সবাই তার দিকে তাকাবে। এটা একটা বিব্রতকর ব্যাপার হবে। নুরুল হক আসামির দিকে তাকালেন। এবং দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। একজন বিচারক হা করে আসামির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন না। বিশেষ করে সেই আসামি যাকে ফাঁসির হুকুম তিনিই দেবেন। তবে এখনো মনস্থির করেন নি। নুরুল হক সওয়াল-জবাবের দিকে মন দিলেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর হামিদ প্রশ্ন করছে। প্রশ্নের মধ্যে নানান নাটকীয়তা। গলার উঠা-নামা। হাত-পা নাড়ানো। নুরুল হকের মনে হলো, হামিদ হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে এইসব শিখেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার নাম?
আলাউদ্দিন; জনাব, আমি আমার নাম অনেকবার আপনাকে বলেছি। গতকালও বলেছি। এক রাতের মধ্যে তো আমি আকিকা করে নাম বদলাতে পারি না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনাকে যা জিজ্ঞেস করা হবে আপনি জবাব দেবেন। আপনার নাম?
আলাউদ্দিন : নাম ভুলে গেছি। আপনি সুন্দর দেখে একটা নাম দিয়ে দেন। কোর্টের খরুচে খাসি জবেহ করে আকিকা করেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনাকে যা প্রশ্ন করা হবে তার জবাব দিতে হবে। আপনার নাম কী?
আলাউদ্দিন : নাম বলব না।
পাবলিক প্রসিকিউটর; বলতেই হবে।
আলাউদ্দিন : বলেছি তো বলব না। আপনি এক কাজ করেন, আমাকে শাস্তি দেন। নাইলনের দড়ি দিয়ে কোর্টের মধ্যেই নিজের হাতে সিলিং ফ্যানে ঝুলায়ে দেন।
আলাউদ্দিন সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে কল্পনায় সিলিং ফ্যানে ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখছে। কোর্ট রুমে জোরালো হাসির শব্দ হলো। নুরুল হক এই ফাঁকে কেশে বুকের কফ পরিষ্কার করে নিলেন। এখন তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে পাবলিক প্রসিকিউটরের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। নাম কী নাম কী বলে লেবু কচলায়ে বিষ বানায়ে ফেলেছে। সারাদিন চলে যাবে নাম জানতে। আসামির মুখ থেকে নাম যেন জানতেই হবে। আসামিও ঔদড় আছে। নাম বলবে না। তার নিজেরই একবার ইচ্ছা করছিল বল–আসামির নাম আলাউদ্দিন। তার বাবার নাম নাসিমুদ্দিন।
জজ হিসাবে তার ভূমিকা রাখা উচিত। হিন্দি সিরিয়ালে দেখা যায়, জজদের হাতে কাঠের হাতুড়ি থাকে। তারা হাতুড়ি দিয়ে হাসির শব্দ বা হৈচৈ থামান। বাস্তবে হাতুড়ি বলে কিছু থাকে না। থাকলে ভালো হতো। টেবিলে বাড়ি দিয়ে বলতে পারতেন, order! order!
নুরুল হক শব্দ করে গলা খাঁকারি দিলেন। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেল বুক পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেল এবং হাসির শব্দ থেমে গেল। আসামি এবং পাবলিক প্রসিকিউটর দুজনই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আসামিকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে। হামিদকে দেখাচ্ছে দাড়িবিহীন ছাগলের মতো।
নুরুল হক বললেন, কোর্টের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলা বাঞ্ছনীয়। আসামিকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে যথাযথভাবে প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে।
হামিদের মুখে হাসি দেখা গেল। এই হাসির নাম আকৰ্ণ বিস্তৃত হাসি। তার সবকটা পান খাওয়া লাল দাঁত দেখা যাচ্ছে। নুরুল হক যথেষ্টই বিরক্ত হলেন। দাতের বিষয়ে তাঁর শুচিবায়ু আছে। প্রতিবার খাওয়ার পরে তিনি দাঁত ব্রাস করেন। তার ধারণা একজন মানুষের স্বভাব-চরিত্রের বড় পরিচয় তার দাঁত। আসামির দাঁতগুলি একবার দেখতে পারলে হতো। তবে তিনি তো আর আসামিকে বলতে পারেন না–দেখি, দাঁত দেখি।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার নাম?
আসামি : আলাউদ্দিন।
পাবলিক প্রসিকিউটর; আপনার পিতার নাম?
আসামি : আমার বাবার নাম আমি বলব না। কারণ আমি আসামি, আমার বাবা আসামি না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার বাবার নাম বলুন।
আসামি : ডঃ আব্দুল হাই। Ph.D
পাবলিক প্রসিকিউটার; আপনার বাবার নাম নাসিমুদ্দিন। তাহলে কেন বললেন ডঃ আব্দুল হাই Ph.D?
আসামি : আপনি আমার বাবার নাম জানেন কি-না, তা জানার জন্যে করেছি। এখন দেখা যাচ্ছে আপনি জানেন। খামাকা বিরক্ত করছেন।
কোর্টরুমে আবারো হাসির শব্দ উঠল। এবারের হাসির শব্দ আগের চেয়েও জোরালো। নুরুল হক বিরক্ত মুখে ইশারায় হামিদকে কাছে ডাকলেন। হামিদ গলা নামিয়ে বলল, বদের বাচ্চার অবস্থাটা দেখেছেন স্যার। ঠাট্টা ফাজলামি করছে।
নুরুল হকের নাকে ভক করে জর্দার কড়া গন্ধ লাগল। তিনি বললেন, আপনি কোর্ট রুমে পান জর্দা এইসব খান নাকি?
না তো স্যার।
আগুমেন্টে আসার আগে দেখলাম টিনের কৌটা খুলে পান মুখে দিলেন।
নো, নেভার।
নুরুল হকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি মিথ্যা সহ্য করতে পারেন না। অথচ তার কাজই এমন যে বাস করতে হয় মিথ্যার মধ্যে। নুরুল হক বললেন, নাম কী তা দিয়ে তো আপনি সারা দুপুর নষ্ট করছেন। মূলে চলে আসুন।
হামিদ বললেন, নাম তো স্যার মূলের মূল।
আপনি এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেবেন নাম জানার জন্যে? আপনি কোর্টের সময় নষ্ট করছেন।
স্যার, আসামিকে খেলায়ে ডাঙায় তুলতে হলে শুরু থেকে ধরতে হয়।
আসামি মাছ না যে তাকে খেলায়ে ডাঙায় তুলতে হবে। আর আপনিও মাছ শিকারি না।
হামিদ চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, স্যার, আমার বিষয়ে কি আপনার অনাস্থা আছে? আপনি কি মনে করেন যে আমি কম্পিটেন্ট না?
নুরুল হক বললেন, আমি কিছুই মনে করছি না। ঠিক আছে যান। যা ইচ্ছা করুন।
হামিদ এমনভাবে যাচ্ছে যেন যুদ্ধ জয় করে শিবিরে ফিরে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসিও আছে। সবই হিন্দি সিরিয়ালের কোর্ট সিন থেকে শেখা। হিন্দি সিরিয়ালগুলি অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস শেখাচ্ছে। তিনি নিজেও কিছু কিছু শিখছেন। যেমন একটা শায়ের শিখলেন–
দানে দানে পর লিখ্যা হায়
খানেওয়ালাকা নাম
গুল্লি গুল্লিপর লিখ্যা হয়
মরনেওয়ালেকা নাম।
এর অর্থ, খাবারের প্রতিটি দানায় লেখা আছে যে খাবার খাবে তার নাম। একইভাবে প্রতিটি গুলিতে লেখা আছে যে মারা যাবে তার নাম।
নুরুল হকের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল চুলকাচ্ছে। বুড়ো আঙুল চুলকানোর রোগটা তার নতুন হয়েছে। চুলকানি শুরু হয় ঘুম ভাঙার পর পর। ঘন্টাখানিক চলে। আবার দুপুরের দিকে শুরু হয়। ফরাসি একটা প্রবচন আছে—পঞ্চাশ বছর পার হবার পর ভোরবেলা শারীরিক কোনো যন্ত্রণা ছাড়া যদি ঘুম ভাঙে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি মারা গেছ। তাঁর বয়স তিপ্পান্ন। ভোরবেলা কোনো একটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম ভাঙবে এটাই স্বাভাবিক।
কোর্টে নতুন করে আগুমেন্ট শুরু হয়েছে। হামিদ ছাগলাটা লাল একজোড়া জুতা নিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছে। বিরাট অভিনেতা। নুরুল হক তার অভিনয়ে নজর দিতে পারছেন না। তিনি চেষ্টা করছেন ফরাসি প্রবচন কোথায় শুনেছেন সেটা মনে করার। আজকাল স্মৃতিশক্তির সমস্যা হচ্ছে। কিছু মনে থাকছে না। সামুদ্রিক মাছের তেল খেলে না-কি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। ভিটামিন ওমেগা নামের কী যেন সামুদ্রিক তেলে আছে। প্রবচন নিয়ে চিন্তা না করে অন্যকিছুতে মন দিলে ঝট করে মনে পড়তে পারে। নুরুল হক উকিল কথাবার্তা কী বলছে শোনার চেষ্টা করলেন–
পাবলিক প্রসিকিউটর; এই জুতা জোড়া কি আপনার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল?
আসামি; পুলিশ বলছে পাওয়া গেছে। যখন পাওয়া গেছে তখন আমি ঘরে ছিলাম না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : বলতে চাচ্ছেন পুলিশ মিথ্যা বলছে?
আসামি : পুলিশ মিথ্যা বলবে এটাই স্বাভাবিক না? যে বাচ্চাটিকে আমি খুন করেছি বলে বলা হচ্ছে তার জুতী আমি ঘরে কেন সাজিয়ে রাখব? আপনি বোকা হতে পারেন। আমি তো বোকা না।
বোকা শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নুরুল হকের মনে পড়ল এই প্রবচনটা তিনি শুনেছেন এক বোকার কাছে। বোকাটা তার স্ত্রীকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে এসে বর্তমানে তাঁর বাড়িতে আছে। বোকাটা তার একমাত্র মেয়ের জামাই। নাম সুজন। ছেলেটা যে এত বোকা আগে বুঝতে পারেন নি। যতই দিন যাচ্ছে তার বোকামি ততই matured হচ্ছে। সে একটা ভিজিটিং কার্ড বানিয়েছে, সেখানে নিজের নাম সুজন লিখেছেন এইভাবে–
shoe john.
ইউরোপ আমেরিকায় জন মানে বাথরুম। তাহলে তার নামের অর্থ দাঁড়াচ্ছে জুতা বাথরুম। আরো খারাপভাবে বললে– জুতা টাট্টিখানা।
বোকাটা 6R সাইজের দুটা ছবি নিয়ে এসেছে। আগ্রহ করে ছবি দেখিয়েছে। ছবি দেখে কিছুক্ষণের জন্যে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। কারণ একটা ছবিতে প্রেসিডেন্ট বুশ সুজনের গলা জড়িয়ে ধরে আছেন। অন্য ছবিতে প্রেসিডেন্ট কেনেডি আরবি কায়দায় সুজনের গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে আছেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী?
সুজন বলল, ফটোশপে করে দিয়েছে। হানড্রেড পারসেন্ট রিয়েল মনে হয়। একশ ডলার করে নিয়েছে। দুটা ছবিতে দুশ ডলার চলে গেছে। টেন পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পাওয়ায় টোটাল একশ আশি ডলার লেগেছে।
তিনি বললেন, একশ আশি ডলার খরচ করে এই জিনিস বানানোর মানে কী?
ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখব। লোকজন দেখবে। অবাক হবে।
নুরুল হক কঠিন গলায় বললেন, আমার বাড়িতে এই ছবি টাঙাবে না।
না কেন?
আমি লোকজনকে অবাক করতে পছন্দ করি না। তুমি নিউইয়র্কে একটা মুদির দোকান চালাও। তোমার গালে প্রেসিডেন্ট কেনেড়ি চুমু খাচ্ছেন ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর সেটা কি তুমি জানো? আমার মেয়ে নায়লা কী করে এটা অ্যালাউ করল তা তো বুঝলাম না।
নায়লা ব্যাপারটা খুব স্পোর্টিংলি নিয়েছে। সে নিজেও একটা ছবি তুলেছে টম হ্যাংসের সাথে।
টম হ্যাংসটা কে?
ফিল্মের হিরো। পলিটিক্যাল কেউ না। সুপার হিরো।
সেই ছবি কোথায়?
সেই ছবি দেখলে আপনি রাগ করতে পারেন এইজন্যে আপনাকে দেখানো হয় নি। তবে রাগ করার কিছু নাই। পুরোটাই তো Fake, আব্বা কি ছবিটা দেখতে চান?
হ্যাঁ চাই।
একটা সেকেন্ড, আমি নিয়ে আসছি।
ছবি দেখে নুরুল হক হতভম্ব। ছবিতে বোকা বোকা চেহারার এক যুবক নায়লাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে।
হঠাৎ নুরুল হকের অস্থির লাগা শুরু হয়েছে। বুড়ো আঙুলের যন্ত্রণাটাও বাড়ছে। তিনি জটিল আর্গুমেন্ট থামিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আদালত আজকের মতো শেষ।
তিনি এজলাস ছেড়ে খাস কামরার দিকে এগুচ্ছেন, পেছনে পেছনে আসছে হামিদ।
হামিদ বলল, স্যার কি কোনো কারণে আমার ওপর বিরক্ত?
মিথ্যা কথা বলার জন্যে সামান্য বিরক্ত।
মিথ্যা কথা কখন বললাম? ও আচ্ছা, পান খাওয়ার বিষয়টা বলছেন? মনের ভুলে এক খিলি পান মুখে দিয়ে ফেলতেও পারি। সরি ফর দ্যাট। এরকম আর হবে না।
ঠিক আছে।
স্যার, আমার আর্গুমেন্ট কেমন দেখলেন? ব্যাটাকে তো শুইয়ে ফেলেছিলাম। আজ যদি আরেকটু সময় দিতেন তাকে পুরোপুরি নক আউট করে দিতাম। বদমাইস।
নুরুল হক বললেন, আমার পেছনে পেছনে আসবেন না। প্লিজ।
নুরুল হক আজ অন্যদিনের চেয়ে সকালে বাড়ি ফিরলেন। বসার ঘরে ঢুকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট বুশ এবং মেয়ের জামাইয়ের ছবি বাঁধানো অবস্থায় ঝুলছে। প্রেসিডেন্ট কেনেডির ছবিটাও নিশ্চয় আছে। অন্য কোনো ঘরে ঝুলানো হয়েছে।
নুরুল হকের ধারণা ভুল না। দ্বিতীয় ছবিটি তারই শোবার ঘরে। নায়লার মায়ের ছবির পাশে সাজানো। জামাইয়ের স্পর্ধা দেখে তিনি স্তম্ভিত হলেন। তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডের মতো অপরাধ করেছে বলে তার ধারণা। পেনাল কোডে নতুন নতুন ধারা যুক্ত করার সময় হয়েছে। পৃথিবী বদলাচ্ছে, সময় বদলাচ্ছে, নতুন নতুন অপরাধ তৈরি হচ্ছে।
বাবা, কখন এসেছ?
নুরুল হক মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ের মুখ হাসিহাসি। তার গায়ে অ্যাপ্রন, মনে হয় রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। নায়লা বলল, বাবা! আজ আমেরিকান ডিশ খাওয়াবো। বিফ রোস্ট।
নুরুল হক বললেন, ভাত কি রান্না হচ্ছে?
নায়লা বলল, বিফ লোস্ট ভাত দিয়ে কেউ খায় না বাবা। স্মেসড পটেটো করছি।
নুরুল হক বললেন, এইসব আবর্জনা আমি খাই না। ভাত ডাল করতে বল। ডিম ভাজতে বল।
এত কষ্ট করে রান্না করেছি।
তোরা দুইজন মিলে খা। আরেকটা কথা, তুই কোন অভিনেতাকে নিয়ে যে ছবিটা তুলেছিস সেটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলবি। আজই ছিঁড়বি।
নায়লা বলল, বাবা ঐটা তো একটা Fake ছবি।
নুরুল হক বললেন, Fake আলামত তুচ্ছ করার বিষয় না। অনেক সময় Fake আলামত, Fake কথাবার্তায় ফাঁসি হয়ে যায়।
একটা ছবি তোলার জন্যে আমার ফাঁসি হয়ে যাবে?
গাধা বিয়ে করে তুই গাধি হয়ে যাচ্ছিস। এর বেশি আমি কিছু বলব না। তোর গাধা স্বামীকে জিজ্ঞেস কর সে কোন সাহসে তার মৃত শাশুড়ির ছবির পাশে তার এই ছবি টাঙিয়েছে?
নায়লা বলল, ঐ জায়গাটায় পেরেক পোতা ছিল বলে আমি নিজে টাঙিয়েছি।
নুরুল হক বললেন, তোর পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা জরিমানা হওয়া উচিত। অনাদায়ে আরো দুই বছর কারাদণ্ড ছবি নামিয়ে এক্ষুনি নর্দমায় ফেল।
দুপুরে আলু ভাজি, ডাল এবং ভাত খেয়ে নুরুল হক ঘুমুতে গেলেন। ঘুম ভালো হবে না তিনি জানেন। ফাঁসি হবার সম্ভাবনা আছে এসব মামলা যখন চলে, তখন তার ঘুম ভালো হয় না। বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখেন। দুঃস্বপ্নে যার ফাঁসি হবার কথা সে সবসময় উপস্থিত থাকে। কদর্য সব অঙ্গভঙ্গি করে। কদাকার চেহারা নিয়ে স্বপ্নে উপস্থিত হয়।
স্বপ্নগুলি বেশিরভাগ দেখেন রাত তিনটার দিকে। তারপর তার আর ঘুম হয়। তিনি জেগে বসে থাকেন। সূরা ইয়াসিন পাঠ করেন। যদি মন শান্ত হয়। মন শান্ত হয় না। একটা মানুষের জীবন মৃত্যু তার কলমে–ভাবতেই গা শিরশির করে। আলাউদ্দিনের কথাই ধরা যাক। বয়স চল্লিশ। তাকে এত বড় করার জন্যে পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে চল্লিশবার ঘুরতে হয়েছে। কলমের একটা লেখায় সে শেষ, অথচ পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতেই থাকবে। কোনো মানে হয়?
ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবের কারণে নুরুল হক গায়ের ওপর চাদর দিয়েছেন। ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ নায়লার কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মফস্বল শহরে ডিসট্রিক্ট জজের বাড়ি বিশাল বাড়ি। মেয়েটা দূরে অন্য কোনো কামরায় কাঁদতে পারে, অথচ কাঁদছে আশেপাশে যাতে তিনি শুনতে পান। গাধি মেয়ে।
নায়লার কান্না শুনতে শুনতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্ন শুরু হলো। স্বপ্নে তিনি বাড়ির পেছনে বকুল গাছের নিচে চেয়ারে বসা। তার সামনের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে আলাউদ্দিন বসে আছে। আলাউদ্দিনের হাতে পানের কৌটা। সে একটা পান মুখে দিয়ে পিক ফেলল। পিকের রঙ টকটকে লাল। আলাউদ্দিন তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, স্যার কি একটা পান খাবেন?
আমি পান খাই না।
মহেশখালির পান। মুখে দেয়া মাত্র মাখনের মতো মিলে যাবে। সামান্য একটু জর্দা দিয়ে খেয়ে দেখেন। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা।
আমার স্ত্রী পান খেতেন। আমি খাই না।
আচ্ছা স্যার, মামলার অবস্থাটা কী বলেন। পুলিশের সাক্ষী প্রমাণ তো খুবই দুর্বল। একজন পানওয়ালা জোগাড় করেছে যে বলছে আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তার দোকান থেকে ম্যাঙ্গোবার কিনে বাচ্চার হাতে দিয়েছি। পুলিশের জোগাড় করা মিথ্যা সাক্ষী।
নুরুল হক বলেন, মিথ্যা সাক্ষীর ওপরও অনেক সময় ফাঁসি হয়।
আপনার ক্ষেত্রে হবে না। আপনি কঠিন লোক। তবে স্যার পাবলিক প্রসিকিউটর জুতা জোড়া নিয়ে যে যাত্রাপালার পাট গাওয়া শুরু করেছে সেটা বন্ধ করা দরকার। এই বিষয়ে কি আপনি একমত?
হুঁ।
যে কাঁদছে সে আপনার মেয়ে?
হুঁ।
তাদের সন্তানাদি কী?
তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। অনেক চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নি।
টেস্টটিউবে যেতে বলেন।
এইসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছি না।
আলাউদ্দিন আরেকটি পান মুখে দিতে দিতে বলল, ছেলেপুলে না হওয়ার ভালো দিকও আছে।
ভালো দিক কী?
কেউ তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলতে পারবে না। মুক্তিপণ চাইতে পারবে না। ঠিক বলেছি না স্যার?
হুঁ।
একটা পান দিই, খেয়ে দেখেন। মৃতা স্ত্রীর কথা মনে করে খাবেন। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। স্যার, পান দেব?
দাও।
স্বপ্নের মধ্যে পান চিবুতে চিবুতে তাঁর ঘুম ভাঙল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন। ঘর অন্ধকার, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
নায়লা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। নরম গলায় বলল, বাবা চা দেব?
চায়ের সঙ্গে এক পিস কেক খাবে? ফুট কেক। আমি বানিয়েছি।
না, শুধু চা।
নায়লা চা আনতে গেল। তিনি স্ত্রীর ছবির দিকে তাকালেন। ছবির পাশে কেনেডি সাহেবের ছবি নেই। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
নায়লা চা এনে বাবার পাশে বসল। আদুরে গলায় বলল, তুমি হুটহাট করে এমন রাগ কর কেন বাবা?
নুরুল হক বললেন, বয়স হয়েছে, মনে হয় এইজন্যে।
নায়লা বলল, বাবা, আমি তোমার সঙ্গে নয়মাস থাকব।
নুরুল হক বললেন, থাকতে চাইলে থাকবি। সমস্যা কী?
তোমার জামাইও থাকবে। সে আমাকে ছাড়া একঘণ্টাও থাকতে পারে না, এইজন্যে থাকবে। আমি বললাম, তোমার গ্রোসারি শপের কী হবে? সে বলল, গোল্লায় যাক গ্রোসারি শপ। তুমি যেখানে আমি সেখানে।
নুরুল হক কিছু বললেন না, চায়ে চুমুক দিলেন। চা-টা খেতে ভালো হয়েছে। নায়লা বলল, বাবা! নয়মাস কেন তোমার এখানে থাকব বুঝতে পেরেছ?
বাবার সঙ্গে থাকবি, এর মধ্যে বুঝাবুঝির কী আছে?
নায়লা বলল, আমার বাচ্চা হবে। এখন দুইমাস। আমেরিকান ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছেন। বাবা, তুমি আমাদের দুজনকে গাধা বলে, তোমারও কিন্তু বুদ্ধি কম।
এতদিন বাচ্চা হবার খবরটা বলিস নাই কেন?
লজ্জা লাগছিল বাবা।
নুরুল হক বললেন, আয় আমার কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক।
নায়লা বাবার কোমর জড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোলে মাথা রেখে শুয়ে ফোপাতে লাগল।
নুরুল হক বললেন, তোর জামাই কোথায়?
নায়লা বলল, আশেপাশেই আছে। তোমাকে খুব ভয় পায় তো, এইজন্যে দূরে দূরে থাকে।
কোর্ট শুরু হয়েছে।
আলাউদ্দিন আজ হালকা নীল রঙের হাফশার্ট পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে। নুরুল হক পাবলিক প্রসিকিউটরের হাত থেকে জুতাজোড়া চেয়ে। নিলেন। দেড় দুবছর বয়সি ছেলের রঙিন জুতা। চাপ দিলেই বাজনা বাজে। জুতার একপাশ থেকে আলো বের হয়। সুন্দর সুন্দর জিনিস বের হচ্ছে। এরকম এক জোড়া জুতা তাকে তার নাতি বা নাতনির জন্যেও কিনতে হবে। জুতা পায়ে সে ঘুরবে, ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বাজনা বাজবে। বাচ্চার মা নিশ্চিত থাকবে, বাচ্চা জুতা পায়ে কোথায় যাচ্ছে শব্দ শুনে বুঝে যাবে। নুরুল হক বেশ কয়েকবার জুতা টিপে আওয়াজ করলেন।
শব্দটা শুনতে ভালো লাগছে। একজন জজ সাহেব জটিল খুনের মামলায় জুতা নিয়ে খেলতে পারেন না। তিনি কাঠগড়ার দিকে তাকালেন। কাঠগড়ায় আছে নিজাম। পান-বিড়ি দোকানের মালিক। তাকে ভীত এবং চিন্তিত লাগছে। মনে হয় সে জীবনের প্রথম কাঠগড়ায় উঠেছে। হতাশ চোখে চারদিক দেখছে। তার কপালভর্তি ঘাম। একটু পর পর সে অতি নোংরা রুমাল দিয়ে কপাল মুছলো। উকিল প্রশ্ন শুরু করলেন। আসামি পক্ষের উকিল। সাত্তার নাম। অতি ধুরন্ধর। হামিদের মতো গর্ধব শ্রেণীর না।
উকিল : আপনার নাম?
নিজাম : জনাব, আমার নাম নিজাম।
উকিল : আপনার একটা পানের দোকান আছে?
নিজাম : জি।
উকিল : আপনি আসামিকে চিনেন?
নিজাম : জি। উনি আমার দোকান থেকে একটা ম্যাঙ্গোবার কিনে বাচ্চাটাকে দিয়েছেন।
উকিল : আপনার দোকানে তো বহু লোক আসা যাওয়া করে। আসামির কথা মনে রেখেছেন কীভাবে? উনি কি প্রায়ই আপনার দোকান থেকে সিগারেট পান বিড়ি এইসব কিনতেন?
নিজাম : জি স্যার।
উকিল : একটা ছোট্ট সমস্যা হলো, আসামি পানও খায় না, সিগারেটও খায়। সে কেন রোজ আপনার দোকান থেকে পান সিগারেট কিনবে?
নিজাম হতাশ চোখে তাকাল। ঢোঁক গিলল।
উকিল : ঐ প্রসঙ্গ থাক। জুতাজোড়ার দিকে তাকান। জুতাজোড়া চেনেন?
নিজাম : জি স্যার, বাচ্চাটার পায়ে ছিল।
উকিল : একটা বাচ্চা কাঁদছে। তাকে আপনি ম্যাঙ্গোবার দিলেন। আপনার তো বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকার কথা। আপনি জুতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
নিজাম : স্যার জুতার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হয়েছে, এইজন্যে জুতার দিকে তাকিয়েছি।
উকিল : আপনি জবানবন্দিতে বলেছেন আসামি বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আপনার দোকানে এসেছে। বাচ্চা কোলে থাকলে তো জুতার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হবে না। ঠিক কি-না বলুন?
নিজাম : জি স্যার, ঠিক।
উকিল : মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছেন কেন?
নিজাম : মিথ্যা না স্যার, সত্যি।
উকিল : আপনাকে আমার আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই, আপনি কাঠগড়া থেকে নেমে যেতে পারেন।
কাঠগড়া থেকে নামতে গিয়ে নিজাম হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
উকিল বললেন, মাননীয় আদালতকে একটা বিষয় জানাতে চাচ্ছি। নিজাম নামের এই লোক পুলিশের সোর্সের একজন। পুলিশের মামলায় সে প্রায়ই সাক্ষ্য দেয়। এর আগে তিনবার সে ছিনতাই মামলার সাক্ষ্য দিয়েছে। প্রতিবারই সে ছিনতাই হতে দেখেছে। কিংবা ছিনতাইকারী তার দোকান থেকে বিড়ি সিগারেট কিনেছে।
নুরুল হক কোর্টের কার্যক্রম শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। আজ বৃষ্টি হচ্ছে। ভালো বৃষ্টি। ইচ্ছা করছে একটা রিকশা নিয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে। তা সম্ভব না। তাকে গাড়ি নিয়েই ফিরতে হবে। দুপুরে মেয়ে-জামাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন। বাবুর্চি সালাম রান্না করেছে। সজনে ডাটা দিয়ে পাবদা মাছ। পাবদা মাছের সঙ্গে সজনে যায় না, তারপরেও খেতে ভালো হয়েছে। তার মেজাজ এখন বেশ খারাপ, কারণ মেয়ে জামাই মুরাদ কাঁটা চামচ দিয়ে পাবদা মাছ খাচ্ছে।
মুরাদ বলল, আব্বা, আপনার মামলার কথা সালামের কাছ থেকে শুনেছি। ফাঁসি কি হবে?
নুরুল হক বললেন, এখনো তো মামলা শেষ হয় নাই।
মুরাদ বলল, বছরের পর বছর মামলা না চালিয়ে লটারিতে চলে যাওয়া দরকার। সময় বাঁচে।
নুরুল হক বললেন, লটারি মানে?
মুরাদ বলল, একটা কাগজে লেখা থাকবে দোষী। আরেকটায় লেখা থাকবে নির্দোষী। বিসমিল্লাহ বলে আপনি কাগজ তুলবেন। যেটা উঠবে সেটা। দোষী উঠলে ফাঁসি। নির্দোষী উঠলে খালাস।
নুরুল হক বললেন, আমি খাবার টেবিলে কথাবার্তা পছন্দ করি না। নিঃশব্দে খাও।
মুরাদ বলল, খাওয়ার টেবিলে আলাপ আলোচনা হজমের সহায়ক। আমি রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছি। একটা অসাধারণ পত্রিকা। সব ইনফরমেশন আছে।
নুরুল হক আধখাওয়া অবস্থায় টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। রাতে তার জ্বর উঠল। তিনি জ্বর গায়েই গোসল করে পাকপবিত্র হয়ে ইস্তেখাড়ায় বসলেন। যদি আল্লাহপাক স্বপ্নে কোনো ইশারা দেন। এ ধরনের মামলা চলার সময় তিনি সবারই ইস্তেখাড়া করেন। কোনো লাভ হয় না। ইস্তেখাড়ায় প্রশ্নের উত্তর প্রতীকের মাধ্যমে আসে। প্রতীক থেকে অর্থ উদ্ধার সহজ কর্ম না। বড় বড় আলেম ছাড়া কেউ পারে না।
ইস্তেখাড়ায় স্বপ্নে দেখলেন দুটা দাড়কাক। একজন আরেকজনকে ঠুকরে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে। কাক দুটি কা কা করছে না। ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। বাকি রাত তিনি জেগে কাটালেন।
তদন্তকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। মামলার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিবেন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর : আসামি ছেলেটার বাবা-মার কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিশ লক্ষ টাকা চেয়েছিল। ছেলেটার বাবা দশ লক্ষ টাকা জোগাড় করে পাঠান। পুলিশকে এই বিষয়ে তারা কিছুই জানান নি।
আসামি দশ লাখ টাকার ব্রিফকেস রেখে আরো দশ লাখের জন্যে চাপ দেয়। তখন তারা পুলিশকে জানায়। আমরা তখন ফাঁদ পাতি। আসামিকে আরো দশ লাখ টাকা নেবার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলি। আসামি আসে। আমরা তাকে গ্রেফতার করি।
আমরা তার মোবাইল সেট জব্দ করি। মোবাইল থেকে যে টেলিফোন করে টাকা চাওয়া হয়েছে তা ফোনের রেকর্ড থেকে নিশ্চিত হই। বাড়ি তল্লাশি করে জুতাজোড়া পাই। এই হলো ঘটনা।
উকিল : এটা যে আসামিরই মোবাইল তার কোনো প্রমাণও নেই। মোবাইল সেটটি নতুন এবং তার সিম কার্ড ফাঁকা।
ইন্সপেক্টর : ফাঁকা বলবেন না। এই সিম কার্ডেই বাচ্চার বাবা-মাকে টাকা চেয়ে টেলিফোন করা হয়েছে।
উকিল; বাচ্চাটির ডেডবডি আপনারা কোথায় খুঁজে পান?
ইন্সপেক্টর : আশুলিয়ায়। একটা বস্তার ভেতর ভরে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল।
উকিল : ডেডবডির সন্ধান কী করে পেলেন? আসামি বলেছে?
ইন্সপেক্টর : না। ডেডবড়ি ভেসে উঠেছিল। স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়।
উকিল : বাচ্চাটির মৃতদেহের ছবি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিষয়ে জানেন?
ইন্সপেক্টর : জানি।
উকিল : ছবিগুলিতে বাচ্চার দুই পায়েই জুতা ছিল। আমি আদালতে ছবি জমা দিচ্ছি। এখন কথা হলো আসামির ঘরে দুটা জুতা কীভাবে এল?
পুলিশ ইন্সপেক্টর থতমত খেয়ে গেলেন
উকিল : মামনীয় আদালত! এটা একটা দুর্বলভাবে সাজানো মামলা। বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবার কথা।
নভেম্বর মাস। এর মধ্যে আলাউদ্দিন বেকসুর খালাস পেয়েছে। নুরুল হক সাহেবের এক নাতি হয়েছে। নাতির নাম রূপম। নুরুল হক সাহেব যতক্ষণ বাসায় থাকেন নাতিকে কোলে রাখেন। নায়লা দূর থেকে লক্ষ করেছে তার বাবা এক মাস বয়েসি নাতির সঙ্গে বিড়বিড় করে মামলা-মোকদ্দমার গল্প করেন।
জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা কী জানো দাদু? যখন ফাঁসি হতে যাচ্ছে এমন একজন লোক নির্দোষ প্রমাণিত হয়। খালাস পেয়ে বাড়িতে চলে যায়। আমার জীবনে কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। বড় হও। বড় হলে শুনবে। এখন দাদু একটু হাস তো।
এক শুক্রবার সকালে নুরুল হকের সঙ্গে দেখা করতে এল আলাউদ্দিন। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। সঙ্গে একটা বড় কাতল মাছ। জীবন্ত। কানকো নড়ছে।
স্যার, আমাকে চিনেছেন? আমি আলাউদ্দিন।
চিনেছি।
স্যারের নাতি হয়েছে শুনেছি। অতি আনন্দের সংবাদ। নাম কী রেখেছেন?
রূপম।
বাহ্ নামও মাশাল্লা সুন্দর।
মিষ্টি-মাছ এইসব আমি রাখব না। কিছু মনে করো না।
আপনি রাখবেন না জানি, তারপরেও নিয়ে এসেছিলাম। চিন্তা করবেন না স্যার। ফিরত নিয়ে যাব।
তুমি আজকাল করছ কী?
আলাউদ্দিন গলা নামিয়ে বলল, রেস্টে আছি। দশ লাখ টাকা লুকানো ছিল, এইটাই খরচ করতেছি।
নুরুল হক হতভম্ব হয়ে তাকালেন।
আলাউদ্দিন বলল, নতুন এক জোড়া জুতা আমিই রেখে দিয়েছিলাম। পুলিশ যখন আলামত হিসাবে জুতা জব্দ করেছে, তখনি বুঝেছি মামলা ডিসমিস। হা হা হা। খুন আমিই করেছি। আপনার মত ঝানু লোক ধোঁকা খেয়েছেন। এইটাই আনন্দের।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ