১৯৬৭ সন। শীতের সকাল। রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের ঘরে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরটা প্রকাণ্ড হলেও অন্ধকার। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। সেই আলো অন্ধকারে প্রথম যা চোখে পড়ছে তা হল অপরিচিত একজন মানুষের তৈলচিত্র। মানুষটি রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন পৃথিবীর সবার উপরেই তিনি বিরক্ত। ক্যামিকেলস-এর গন্ধে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঘরে কোন ধোয়া নেই, তবু মনে হচ্ছে কাঠ-কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে আছে।
চেয়ারে ছোটখাট একজন মানুষ বসে আছেন–তিনিই খোন্দকার মোকাররম হোসেন। চোখে ভারী চশমা। তার মুখ হাসি হাসি, তবে সেই হাসি থেকে কেন জানি কোন ভরসা পাওয়া যায় না বরং ভয় লাগে। তিনি নরম গলায় বললেন, তুমি কেমিস্ট্রি পড়তে চাচ্ছ কেন?
আমি উত্তর দিলাম না। কারণ আমার মনে হল না তিনি কোন উত্তর শুনতে চাচ্ছেন। প্রশ্ন করতে হয় বলেই করা। প্রশ্ন করেই তিনি পাশে বসা অন্য একজন শিক্ষকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলা শুরু করেছেন।
আমার দিকে না তাকালে আমি প্রশ্নের জবাবই বা কেন দেব? আমার একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ এখন যা হচ্ছে তার নাম ভর্তির ইন্টারন্যু। ইন্টারভু ভাল হলে দরখাস্তে সই করে দেবেন। ভর্তি হয়ে যাব। ফট করে কেমিস্ট্রির কোন প্রশ্ন করে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফর্মূলা একটাও মনে নেই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে যাবার পর আর বই খুলে দেখিনি।
আমার খানিকটা একা একাও লাগছে। সবার সঙ্গেই বাবা, খালু বা চাচা এসেছেন। কি পড়লে ভাল হয়, সাবসিডিয়ারী কি নেয়া যায় আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আমি একা। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন–পড়াশোনার ব্যাপারটা তোমার। তুমি যা ভাল মনে কর তাই পড়বে। এখানে আমার বলার কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।
খোন্দকার মোকাররম হোসেন স্যার পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমিস্ট্রি পড়তে কি তোমার ভাল লাগে? বলেই আগের মত পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ মজার ব্যাপার তো!
স্যারের কথা বলা শেষ হল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে তৃতীয় কোন প্রশ্ন না করেই দরখাস্তে সই করে দিয়ে বললেন, মন দিয়ে পড়বে।
ভর্তির ব্যাপারটা খুব সহজে হয়ে গেল। আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। বিরাট এই বিশ্ববিদ্যালয়টা এখন আমার। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার নিজের জায়গায়। আর কি সুন্দর জায়গা! কার্জন হল–ফুলের বাগানের ভেতর লাল ইটের দালান। প্রাচীন প্রাচীন ভাব। এত ছাত্র-ছাত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপরেও যেন সব শান্ত। প্রকাণ্ড দুটা শিরীষ গাছ কেমিস্ট্রি বিল্ডিংটাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
কার্জন হলের পেছনেই কি বিশাল দুটা হল। ফজলুল হক হল এবং ঢাকা হল। এই হল দুটির সামনেও ফুলের বাগান। দুই হলের মাঝখানে সমুদ্রের মত বড় দীঘি। এই হল দুটির কামরাগুলি আমার পছন্দ হল না। কেমন যেন ছোট ছোট। আলো কম। সেই তুলনায় মহসিন হলকে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। নতুন তৈরি হয়েছে। এখনো চালু হয় নি। এ বছরই চালু হবে। ঝকঝক করছে ছতলা আকাশছোঁয়া হল। দুটা লিফট আছে। লিফট আমি আগে কখনো দেখি নি। একবার লিফটে চড়েই মনে হল, এই হলে থাকতে না পারলে মানব জন্ম বৃথা।
মহসিন হলের প্রধান গৃহশিক্ষক তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী। অধ্যাপক মোহাম্মদ এমরান। ইনি কারণে এবং অকারণে অতি দ্রুত রেগে যেতে পারেন। ইনার কাছে ইন্টারভু দিতে যাবার আগ মুহূর্তে একজন আমাকে বলল, স্যারের প্রশ্নের উত্তর খুব সাবধানে দিবে। একজন কি উল্টাপাল্টা কথা বলেছিল, স্যার তাকে চড় মেরেছেন।
কি সর্বনাশের কথা! ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা ছাত্রের গালে কেউ চড় মারতে পারে? ভয়ে এতটুকু হয়ে স্যারের ঘরে ঢুকলাম। স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, সায়েন্সের ছাত্র তুমি মহসিন হলে থাকবে কেন? সায়েন্সের ছাত্রদের জন্যে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল।
আমি স্যার এই হলেই থাকব।
কেন?
এদের লিফট আছে স্যার।
স্যার হেসে ফেললেন। হেসে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল হাসা ঠিক হয় নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করবে না। স্ট্রেইট লাইন চেন? স্ট্রেইট লাইন বানিয়ে ছেড়ে দেব। বিছানা-বালিশ আছে?
আছে স্যার।।
বিছানা-বালিশ নিয়ে পাঁচ তলায় চলে যাও। তোমাকে একটা সিঙ্গেল সীটেড রুম দেয়া হল।
হলে ভর্তি, হলে সীট পাওয়ার ব্যাপারটা এত সহজ? বিশ্বাস হতে চায় না। আমি নিজের ঘরে ঢুকলাম। আগামী চার বছর এটাই আমার ঘর। রুম নাম্বার পাঁচশ চৌষট্টি। একটা কাগজে বড় বড় করে লিখলাম–
হুমায়ূন আহমেদ
রসায়ন প্রথম বর্ষ সম্মান
রোল ৩২
সেই কাগজ ঘরের দরজায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।
নতুন হলে যাত্রা শুরু হল। প্রথম রাতেই ইমপ্রুভড ডায়েট। রোস্ট, রেজালা, দৈ। খাওয়ার শেষে হলের বাইরের দোকান থেকে জীবনের প্রথম সিগারেটটি কিনে গম্ভীর ভঙ্গিতে টানা শুরু করলাম। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছি–অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগারেট টানা যেতে পারে। মাথা ঘুরছে তাতে কি? বমি বমি আসছে? আসুক না। আনন্দময় জীবনের এই তো শুরু।
হলে ভর্তি হবার পরের সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। সকাল আটটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ ব্রেক। দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ল্যাব। ভয়াবহ চাপ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। সায়েন্স পড়ার একি যন্ত্রণা! আর্টস-এর ছেলেরা দেখি মহাসুখে আছে। একটা দুটা ক্লাস করে চলে আসে। দুপুরে ঘুমায়। এদের দেখে ঈর্ষায় গা জ্বলে যায়। হায়! কি বোকামি করেছি। কেন আর্টস পড়লাম না?
আমাদের সময় রসায়ন বিভাগের নিয়ম ছিল সবচে জাঁদরেল শিক্ষকদের দেয়া হত প্রথম বর্ষের ক্লাস। তাঁরা ছাত্রদের ভিত তৈরি করে দিতেন। শক্ত ভিত তৈরি হলে পরবর্তী সময়ে তেমন সমস্যা হত না।
ক্লাসে যেতে হত তৈরি হয়ে। পাঠশালার মত অবস্থা। স্যাররা প্রশ্ন করে করে অস্থির করে ফেলতেন। ক্লাস থেকে ছাত্র বের করে দেয়া ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। কলেজের স্যারদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের একটা বড় ধরনের প্রভেদ প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেল। কলেজের স্যাররা যখন পড়াতেন তখন মনে হত, যে বিষয়টা তাঁরা পড়াচ্ছেন সে বিষয়টা তাঁরা নিজেরা খুব ভাল জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা দেখলাম শুধু যে জানেন তা না, এত ভাল করে জানেন যে ছাত্র হিসেবে ভয় ধরে যায়।।
ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াতেন প্রফেসর আলি নওয়াব। তখন অবশ্যি তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক)। ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বইগুলিতে যা পড়বে সবই বিশ্বাস করবে না। অনেক মিথ্যা কথা লেখা আছে।
আমরা স্তম্ভিত। বই-এ মিথ্যা কথা মানে?
স্যার বললেন, বইগুলিতে অনেক ভুল তথ্য থাকে। আমি সেগুলি তোমাদের দেখিয়ে দেব। তোমরা নিজেরাও ধরতে চেষ্টা করবে। প্রচুর গোঁজামিল আছে। ভুল থিওরী আছে।
আমরা বিস্মিত, বই-এ লেখা থিওরী ভুল! কি আশ্চর্য কথা। স্যার শুধু মুখেই বললেন না–ভুল দেখিয়ে আমাদের চমকে দিলেন।
চার ঘণ্টার ল্যাব। এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই। কাজ শেষ করতে হবে। অসংখ্য কাজ। গোদের উপর বিষফোড়ার মত ল্যাব ক্লাসে দুদিন পরপর ভাইভা। ভাইভা ভাল না হলে স্যাররা স্কলারশীপের বিলে সই করেন না। গার্ডিয়ানের কাছে চিঠি চলে যায়–পড়াশোনা সন্তোষজনক নয়।
আজ যখন কেউ বলে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেমন কেটেছে? আমি নস্টালজিক কারণে বলি, খুব চমৎকার! অসাধারণ!
আসলে কিন্তু খুব চমৎকার বা অসাধারণ জীবন তা ছিল না। কেন ছিল না একটু বলি চব্বিশ বছর আগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। শিক্ষকরা ছিলেন অন্য গ্রহের মানুষ। তাঁরা অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। ক্লাস রুমের বাইরে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়। ছাত্রদের কোন সমস্যায় তাঁদের কোন সহানুভূতি ছিল বলেও মনে হয় না।
না-হওয়াটাই স্বাভাবিক। যোগাযোগ থাকলে তবেই তো সহানুভূতি তৈরি হবে। যোগাযোগই তো নেই।
একটা ঘটনা বলি–রসায়ন বিভাগের বারান্দায় একটি ছেলে এবং মেয়ে মাথা নিচু করে গল্প করছিল। গল্প করার ভঙ্গিটি হয়ত আন্তরিক ছিল। এবং তারা গল্পও করছিল দীর্ঘ সময়। চেয়ারম্যনের ঘরে দুজনেরই ডাক পড়ল। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কি বললেন জানি না। মেয়েটি বের হয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। ছেলেটিকে ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে হল।
সন্ত্রাস আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং অন্যতম সমস্যা। চব্বিশ বছর আগেও কিন্তু সন্ত্রাস একটি বড় সমস্যাই ছিল। এন এস এফ নামে তখন সরকার সমর্থিত একটি ছাত্র দল ছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল। তারা ঘুরতো হকি স্টিক নিয়ে, ছুরি নিয়ে। কারো কারো হাতে থাকতো রিকশার চেইন। রিকশার চেইন না-কি অস্ত্র হিসেবে ভয়াবহ। দুএকজন ভাগ্যবানের কাছে ছিল পিস্তল।
অন্য হলের কথা জানি না। আমাদের মহসিন হলে মাস্তান ছেলেদের জন্যে হলের বাবুর্চি আলাদা করে রান্না করত। তাদের খাবার পৌঁছে যেত তাদের ঘরে। এর জন্যে তাদের আলাদা কোন টাকা-পয়সা দিতে হত না। হলের শিক্ষকরা এইসব ব্যাপার অবশ্যই জানতেন। জেনেও না জানার ভান করতেন। আমি একটি ভয়াবহ ঘটনার উল্লেখ করে আমার কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করব।
সবে সন্ধ্যা হয়েছে, পলিটিক্যাল সায়েন্সের আমার পরিচিত এক ছাত্র মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ছুটে এসে বলল, ছতলায় এক কাণ্ড হচ্ছে, দেখে। আস। গেলাম ছ তলায়। একেবারে সিঁড়ির গোড়ার ঘরটা বন্ধ। ভেতর থেকে একটি মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ আসছে। বাইরে তিন/চারজন কৌতূহলী ছেলে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম, কি হয়েছে?
তারা চাপা গলায় বলল, একটা মেয়েকে আটকে রেখেছে।
তার মানে কি?
তার মানে যা বলল তাতে আমার মাথা খারাপ হবার অবস্থা। ছ থেকে সাতজন মাস্তান ঐ ঘরে আছে। নারকীয় কাণ্ড হচ্ছে বিকেল থেকে। মেয়েটা এক সময় চিৎকার করছিল–এখন তাও করছে না। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, স্যারদের বলা হয়েছে?
বলা হয়েছে। বলে লাভ নেই–স্যাররাও জানেন কারা এসব করছে।
আমি ছুটে গেলাম আমাদের ব্লকে যে অ্যাসিস্টেন্ট হাউস টিউটর থাকতেন তাঁর কাছে। তিনি বললেন, তুমি তোমার নিজের কাজে যাও, আমরা দেখছি কি করা যায়।
তাঁরা কিছুই দেখলেন না। এই ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। আজকাল কিছু কিছু শিক্ষক যখন বলেন তাঁদের সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন কঠিন। তখন অনেক কষ্টে আমি হাসি চাপি।
আমাদের সময়ই শহীদুল্লাহ হলের (ঢাকা হল) একজন হাউস টিউটরকে অপমান করবার জন্যে এক প্রসটিটিউটকে নিয়ে আসা হল। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাম ধরে ঐ শিক্ষককে ডাকতে লাগল।
সরকার সমর্থিত এন এস এফ এর প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল দেখার মত। কারো হলে সীট হচ্ছে না। এন এস এফ-এর বড় চাঁইকে ধরলেই সীট হয়ে যেত।
ত্রাস সৃষ্টিকারী কিছু চরিত্রের মধ্যে খোকা এবং পাঁচপাত্তুরের নাম মনে পড়ছে। এদের একজন পকেটে জীবন্ত সাপ নিয়ে বেড়াতো বলে শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়। এলাকায় সন্ত্রাসের সূচনা ওরাই করে। আমরা এখন সেই ট্র্যাডিশান বহন করে চলেছি–এর বেশি কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তখনো ছিলেন অসহায়, এখনো অসহায়। তাঁদের মেরুদণ্ড তখনো অশক্ত ছিল। এখনো অশক্ত আছে।
যাক এসব কথা। হল জীবনের কিছু স্মৃতির কথা বলি। হলে থাকা ছেলেদের মধ্যে একটা বড় অংশই ছিল দরিদ্র। অনেকেই প্রথম এসেছে ঢাকা শহরে। কিছুতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। টাকা-পয়সা যা দেশ থেকে আসছে তাতে প্রয়োজন মিটছে না। প্রাইভেট টিউশানি ব্যাপারটি তখনো চালু হয় নি। এদের বাড়তি রোজগার বলতে কিছু নেই। এই ছেলেগুলি কখনো সকালে নাশতা করে না। বিকেলেও কিছু খায় না। ক্ষিধেয় অস্থির হয়ে এরা অপেক্ষা করে কখন রাতের খাবার দেয়া হবে। সন্ধ্যা হতেই এরা ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন ডাইনিং হল খোলা হবে। এদের নিয়ে হলের অন্য ছাত্ররা নানান ধরনের রসিকতা করে। হাসাহাসি করে। হলের স্মৃতি মনে হলেই আমার এই ছেলেগুলির কথা মনে হয়। হল সম্পর্কে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই ছেলেদের সব সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই ক্ষুধার নিচে চাপা পড়ে গেছে। আমি হলে থাকাকালীন সময়েই এদের একজন ইলেকট্রিক হিটারের তার হাতে জড়িয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। না, কোন প্রেমঘটিত ব্যাপার না–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মত অর্থ জোগাড় করতে পারছে না, আবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তেও পারছে না। সে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চায়।
সেই সময়কার খবরের কাগজে আমাদের হলেরই একটি ছেলে বিজ্ঞাপন ছাপাল–সে কোন ধনী পিতার কন্যাকে বিবাহ করতে চায়। বিনিময়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ দিতে হবে। সেই ছেলেকে নিয়ে কত হাসাহাসি। কেউ ভেবেও দেখল না কি গভীর বেদনায় সে পয়সা খরচ করে ঐ বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
চারতলায় থাকতেন এক মৌলানা সাহেব। তার কথা মনে পড়ে। অতি ভদ্রলোক। দেখা হলেই হাসিমুখে নানান খবর জিজ্ঞেস করবেন। ভদ্রলোক ছিলেন মৌলানায়ে মুহাদ্দেস। সম্ভবত আরবী পড়তেন। তিনি একটা পাখি পুষেছিলেন। খাঁচায় বন্দি সেই পাখির যত্ন ছিল দেখার মত। পাখিটি অতিরিক্ত যত্নের কারণেই বোধহয়–মারা গেল। মৌলানা দীর্ঘ একটি শের (কবিতা) রচনা করলেন। যার প্রথম চরণ–
মেরা বুলবুল মর গিয়া।
যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই ধরে ধরে দীর্ঘ কবিতা শুনিয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন।
সপ্তাহখানেক পর তাঁর আত্মীয়স্বজনরা খবর পেয়ে তাকে দেশের বাড়ি নিয়ে গেল। কারণ পাখির শোকে তিনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। এই মৌলানা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন নি।
মহসিন হলের ছতলার একটা ঘর ছিল ভূতে-পাওয়া। বাইরে থেকে তালাবন্ধ কিন্তু ভেতর থেকে গুনগুন গানের শব্দ পাওয়া যায়। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কে যেন স্যান্ডেল পায়ে হাঁটে। রহস্য ভেদ হল দীর্ঘদিন পর। হাউস টিউটররা এক রাতে সেই ঘরে ঢুকে কাবার্ড খুলে রূপবতী এক তরুণীকে আবিষ্কার করলেন। স্যাররা হতভম্ব। জানা গেল মেয়েটি এই রুমের বাসিন্দা স্ট্যাটিসটিকস পড়ে জনৈক ছাত্রের স্ত্রী। দুজনে গোপনে বিয়ে করেছে। দুজনের বাবা-মাই তাদের বের করে দিয়েছে। বেচারা স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাবে! হলে এনে লুকিয়ে রেখেছে কাবার্ডে। এইখানেই এই অসহায় মেয়েটি ছমাস ছিল। দেশের এবং দেশের বাইরের কিছু সংবাদপত্রেও ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। যেসব মাস্তানরা মেয়ে নিয়ে এসে জঘন্য কীর্তি-কাহিনী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কিছুই বলে না। কিন্তু অসহায় এই ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্যে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৬৯ সন। হলের টিভি রুমে আমরা বসে আছি অনেক রাত। রেডিও বাজছে। রানিং কমেট্রি হচ্ছে। অসম্ভব নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মানুষ নামছে চাঁদে। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি–সত্যি কি নামতে পারবে? এই
তো, এইতো নামল। আমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। আনন্দে দুটা চেয়ার ভাঙা হল। জানালার সব কটা কাঁচ ভাঙা হল। একজন উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে অচেতন হয়ে পড়ে গেল। তাকে বাতাস করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকতো। কবিতা পাঠের আসর, গল্প পাঠ, রবীন্দ্র জন্মোৎসব–কিছু না কিছু আছেই। ছাত্রদের প্রবল উৎসাহ। প্রাণশক্তিতে ছেলেরা যে ঝলমল করছে তা স্পষ্ট বোঝা যেত। উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে সেই প্রাণশক্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখলাম। জীবনকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কত তুচ্ছ মনে করে তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। গুলি হচ্ছে নীলক্ষেতে–কারফিউ চলছে। সেই কারফিউ অগ্রাহ্য করে মহসিন হলের ছেলেরা ছুটে গেল। গুলিবিদ্ধ দুটি মানুষকে হলে নিয়ে এল। তখন গভীর রাত। মানুষ দুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা ভীত চোখে দেখছি।
এদের চিকিৎসা প্রয়োজন–কারফিউর ভেতরই ছেলেরা এদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। এই স্মৃতি কি করে ভুলি?
আরেকটি কথা না বললে রচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু হয় মহসিন হলে। ৫৬৪ নম্বর রুমেই রাত জেগে জেগে লিখে ফেলি প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস–নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার। যাত্রা শুরু করি অচেনা এক পথে। সেই পথ দুঃখ ও আনন্দময়।
বছর পাঁচেক আগে মহসিন হলে গিয়েছিলাম। রাত দশটার মত বাজে। চুপি চুপি ৫৬৪ নম্বর রুমের সামনে দাড়িয়ে দরজায় টোকা দিলাম। এক ছেলে দরজা খুলে ভয়ংকর গলায় বলল, কি চাই?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, রং নাম্বার। ভুল জায়গায় এসেছি।
পুরানো তীর্থক্ষেত্র দেখার শখ ছিল। দেখা হল না।
দুটি জিনিস দেখার জন্যে আমার তীব্র কৌতূহল ছিল।
মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। পৃথিবীতে আসা এবং পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার দৃশ্য। জন্মদৃশ্য দেখা তো একেবারেই অসম্ভব। সামাজিক কারণেই পুরুষের পক্ষে জন্মসময়ে উপস্থিত থাকা অকল্পনীয় ব্যাপার।
মৃত্যুসময়ে উপস্থিত থাকাটা সেই তুলনায় অত্যন্ত সহজ। এই সহজ ব্যাপারটি আমার জীবনে ঘটছিল না। আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। চূড়ান্ত অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গিয়েছি। কিন্তু মৃত্যুর সময়টিতে কখনো কাউকে দেখিনি।
এক ডাক্তার বন্ধু হাসপাতালে কাজ করে। তাকে আমি আমার গোপন ইচ্ছার কথা বললাম। সে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি একজন মানসিক রুগী। রুক্ষ গলায় বললো, মানুষের মৃত্যু দেখার কি আছে? এটা তো কোন নাটক না। তুমি কোন একটা অপারেশন দেখতে চাও, আমি ব্যবস্থা করে দি।
মানুষকে কাটা-ছেড়া করার দৃশ্য দেখার ব্যাপারে আমি কোন রকম আগ্রহ বোধ করলাম না। তাকে বলে রাখলাম, হাসপাতালে তো প্রায়ই রুগী মারা যায়। তোমরা ডাক্তার হিসেবে নিশ্চয়ই টের পাও রুগীটি কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। এ-রকম দেখলে টেলিফোন করে দিও। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব। আমি শুধু একবারই দেখতে চাই।
ডাক্তার বন্ধু কথা রাখল। আমাকে খবর দিল। আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছুটে গেলাম। বছর চল্লিশের হতদরিদ্র এক রুগী। কনভালশান হচ্ছে–সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। রুগ্ন এক মহিলা, রুগীটির স্ত্রী হবে–বিছানা ধরে আতংকে ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সাত-আট বছরের দুটি শিশু। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয়াবহ দৃশ্য। রুগীকে দেখেই মনে হল মৃত্যুই তার জন্যে পরম শান্তি। যত তাড়াতাড়ি তার মৃত্যু ঘটবে তত তাড়াতাড়ি সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।
আমার বন্ধু বলল, আর বেশিক্ষণ নেই–তাকিয়ে দেখ অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। অথচ রুগী অক্সিজেন নিতে পারছে না। ফুসফুস ফাংশান করছে না।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার–ডাক্তারদের সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে রুগী দেখতে দেখতে স্বাভাবিক হয়ে গেল। খিচুনি বন্ধ হল। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে শুরু করল। আমি ডাক্তার নই। তবু স্পষ্ট দেখলাম লোকটির মুখ থেকে মৃত্যুর ছায়া সরে যাচ্ছে। মৃত্যু যেন একটা কুৎসিত ননাংরা পশু। পশুটা দাঁত দিয়ে লোকটিকে কামড়ে ধরেছিল–এখন ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়ে সে থাবা গুটিয়ে বসেছে বিছানায়। যে কোন মুহূর্তে বিছানা থেকে লাফিয়ে মানুষটার গায়ে পড়তে পারে। পরাজয় মানতে সে প্রস্তুত নয়। কারণ এখন পর্যন্ত কোন প্রাণী তাকে পরাজিত করে নি। মাঝে মাঝে সাময়িকভাবে সে পরাজয় মানে, লজ্জিত এবং অপমানিত মুখ করে সরে যায়–আবার আসে।
আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভয় নেই, উনি সেরে উঠছেন। এতক্ষণ মহিলা কাঁদেন নি। এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন–ডাক্তার সাহেব, আল্লাহ আপনের ভাল করব। আল্লাহপাক আপনের ভাল করব।
ভদ্রমহিলা আমাকে ডাক্তার ভেবেছেন।
মৃত্যুদৃশ্য দেখা হল না। তবে কল্পনাতীত আনন্দের মুখোমুখি হলে মানুষ কেমন করে তা দেখা হল। এই অভিজ্ঞতাও তুলনাহীন।
আমি লক্ষ্য করেছি, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের চোখের সামনে অসংখ্য মৃত্যু ঘটে। আমার মা এমন একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি–মাকে নিতে দেশের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। মার কোন এক আত্মীয়ের অন্তিম সময় উপস্থিত। মাকে শেষবারের মত না দেখলে তার জীবন বের হচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন, রুগীকে পানি খাওয়ালেন। জীবন বের হবার প্রক্রিয়া সহজ হল।
আমরা তখন কুমিল্লায় ঠাকুর পাড়াতে থাকি। বাসায় একদিন অপরিচিত এক লোক এসে উপস্থিত। হাতে ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার। এসেছে ময়মনসিংহের কলমাকান্দা থেকে। লোকটির বাবা নাকি অনেকদিন আগে আমার মার হাতে কাঁচা পেঁপের ভাজি খেয়েছিলেন। এখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, মার হাতের কাঁচা পেঁপের ভাজি খেয়ে মরতে চান। বাজার থেকে কাঁচা পেঁপে আনা হল। মা রাতে বসলেন। অফিস থেকে এসে সব শুনে আমার বাবা বললেন, তোমার এই বিখ্যাত ভাজি কলমাকান্দায় পৌঁছতে পৌঁছতে পচে গলে যাবে। __ মানুষটার মৃত্যু হবে ফুড পয়জনিং-এ। সেটা কি ঠিক হবে?
মা বললেন, তাই তো।
সন্ধ্যার ট্রেনে মা ঐ মানুষটার সঙ্গে কলমাকান্দা রওনা হয়ে গেলেন। রুগীর বাড়িতেই পেঁপে ভাজা হবে।
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পাশে থাকার আমার তীব্র কৌতূহলের কারণ একটিই–মৃত্যু কিভাবে মানুষকে গ্রাস করে তা দেখা। শেষ মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি কিভাবে পাল্টে যায়। সেই মুহূর্তে সে কি ভাবে তা জানা সম্ভব নয়। সম্ভবত সে কিছুই ভাবে না। কিছু ভাবার ক্ষমতা তার মস্তিষ্কের থাকে না। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে-আসা একজন মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ১৯৭১ সনে দালালীর অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। একটা কাঁঠাল গাছে তাকে বেঁধে খুব কাছ থেকে পর পর দুবার গুলি করা হল। কোনবারই গুলি লাগল না। মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার বললেন, এই লোকটার ভাগ্য তো অসম্ভব ভাল। একে ছেড়ে দেন। তাকে ছেড়ে দেয়া হল।
আমি মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা ভদ্রলোককে বললাম, কাঁঠাল গাছের সঙ্গে যখন বাঁধা হল তখন আপনার চোখ কি খোলা ছিল? চোখ বাঁধা হয় নি?
জ্বি-না। চোখ বাঁধতে ভুলে গিয়েছিল।
তখন কেমন লাগছিল আপনার মনে আছে?
জ্বি-না, মনে নাই। তবে কোন রকম লাগতেছিল না। বন্দুকের যে দুবার গুলির শব্দ হল, একবারও গুলির শব্দ শুনি নাই।
গুলির শব্দ শুনেন নি?
জ্বি না। এটা খুবই আশ্চর্যের কথা–গুলির শব্দ শুনি নাই।
Near Death experience অর্থাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে-আসা মানুষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। তার কিছু কিছু আমি পড়েছি। বেশির ভাগ মানুষই বলেন–তাঁরা দেখতে পান অন্ধকারে একটা টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তীব্র গতিতে যাচ্ছেন, কল্পনাতীত গতিবেগ। টানেলের অন্য প্রান্তে উজ্জ্বল চোখ-ধাঁধানো আলো। তাঁরা ছুটে যাচ্ছেন আলোর দিকে। এক ধরনের সংগীত শোনা যাচ্ছে। এইসব কি শুধুই গল্পগাঁথা? উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা? আমি শুনেছি, অনেকেই নাকি মৃত্যুর সময় তার আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে দেখতে পান। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে! আসলেই কি সত্যি ঘটে? না __ মস্তিষ্কের কারণে হারানো স্মৃতি ফিরে আসে? জানার কোন উপায় নেই।__
প্রায় দশ বছর আগে আমি একটি অসাধারণ বই পড়েছিল—The Private world of dying children. ক্যানসার হাসপাতালের একদল শিশুর নিজস্ব জগৎ নিয়ে জনৈক নার্সের লেখা দুশ পাতার বই। বইটি সে লিখেছিল তার নিজের তাগিদে। পরবর্তী সময়ে এই বইটির জন্যে তাকে মনোবিদ্যায় পি-এইচ ডি ডিগ্রী দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
বইটিতে লেখা হয়েছে একদল শিশুর কথা, যারা জানে তারা মারা যাচ্ছে। খুব অল্প আয়ু তাদের অবশিষ্ট আছে। এই ভয়াবহ সংবাদটি তারা কি করে আত্মস্থ করে–তাঁরা কি ভাবে তাই নিয়ে লেখা অসাধারণ বই। বইটিতে ন বছর বয়েসী একটি মেয়ের কথা আছে যে তার বাবা-মার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত। তাঁরা যখনই তাকে দেখতে আসতেন সে চিৎকার, গালাগালি করত। নার্স একদিন বাচ্চাটিকে তার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করল, সে বলল–দেখ, আমি যদি খুব ভাল ব্যবহার করি তাহলে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মা অনেক বেশি কষ্ট পাবে। সবাইকে বলবে–আমার মেয়েটা কত ভাল ছিল। বলবে আর কাঁদবে। তাই খারাপ ব্যবহার করছি। যাতে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মার কষ্ট কম হয়। এই বই পড়তে পড়তে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। মৃত্যুর আগের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানার ইচ্ছা হয়েছে। ইচ্ছে হলেও সে সুযোগ কোথায়?
আশ্চর্যের ব্যাপার আমার প্রথম ইচ্ছা শিশুর জন্মদৃশ্য দেখা খুব সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ হল। হোটেল গ্রেভার ইন বইটিতে সেই প্রসঙ্গ লিখেছি–আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার জন্মদৃশ্য আমাকে ডাক্তাররাই দেখালেন। আমি স্ত্রীর হাত ধরে তখন পাশেই ছিলাম। অবাক হয়ে শিশুর জন্ম দেখলাম। ডাক্তাররা তার পা উঁচু করে ধরে আছেন। প্রাসেন্টার সঙ্গে শিশুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখনো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া শুরু হয়নি। ডাক্তার শিশুটির পিঠে ছোট্ট করে থাবা দিলেন। সে তৎক্ষণাৎ কাঁদতে শুরু করল। তার ফুসফুস সচল হল–নতুন একটি জগতে সে প্রবেশ করল। কত-না বিস্ময় তার চোখে!
তাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে তার মার কোলে শুইয়ে দেয়া হল। কি অবাক কাণ্ড! সে চোখ বড় বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে পলক পড়ছে না। আমি মনে মনে বললাম, মামণি আমি তোমার বাবা। বিপুল আনন্দের এবং অসাধারণ সৌন্দর্যের এই পৃথিবীতে তুমি এসেছ–আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি–Welcome my little angel.
আমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটি পূর্ণ করার ব্যবস্থাও প্রকৃতি করে দিলো। আমার ছেলের মৃত্যু হল আমার চোখের সামনে। মৃত্যুর সময় সেও আমার মেজো মেয়ের মতই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে–। সেই দৃষ্টি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ছুটে পালিয়ে এলাম। আবারও ছুটে গেলাম তার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মেলে আমাকে দেখল। আমি আবার পালিয়ে গেলাম।
দুটি দৃশ্য দেখার আমার খুব শখ ছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর (?) আমার দুটি ইচ্ছাই পূর্ণ করলেন।
ঘড়ি নামক বস্তুটির প্রতি আমার আশৈশব দুর্বলতা।
কেউ আবার মনে করে বসবেন না আমি হাই থটের কিছু বলার চেষ্টা করছি–ঘড়ি বহতা সময়ের প্রতীক, মহাকালের প্রহরী ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটেই সে রকম কিছু নয়। আমার দুর্বলতার কারণ ঘড়ি সুন্দর একটা জিনিস। সেকেণ্ডের কাঁটা ক্রমাগত ঘুরছে। তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বস্তুটির প্রাণ আছে। কানের কাছে ধরলে হৃদপিণ্ডের শব্দের মত টিকটিক শব্দ হয়।
ক্লাস এইটে প্রথম বৃত্তির টাকা পেয়ে মাকে বললাম, একটা ঘড়ি কিনে দাও।
মা চমকে উঠে বললেন, এই বয়সে ঘড়ি কি রে? আমি তো আমার জন্মে শুনি নি মেট্রিকের আগে কেউ ঘড়ি পরে। না না, এইসব চিন্তা বাদ দে।
লোয়ার কোর্টে মামলা খারিজ হবার পর হাইকোর্টে আপীল করা হয়। আমিও তাই করলাম। এক সন্ধ্যায় বাবার কানে গোপন ইচ্ছার কথা তুললাম। নিজের বলার সাহস নেই। ছোট বোন শেফু আমার হয়ে বলল।
বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, এই বাচ্চা বয়সে ঘড়ি? বাবুয়ানা শেখা হবে। সব কিছুর একটা সময় আছে। প্রথম দাড়ি-গোঁফ কামাতে হয় মেট্রিক পাসের পর। ঘড়ি কিনতে হয় কলেজে উঠে। আমি প্রথম ঘড়ি কিনি বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময়। পাঁচ টাকার কেনা ঘড়ি–এখনো পরছি।
হাইকোর্টে মামলা খারিজ।
আমার ব্যথিত মুখ দেখে হয়ত বাবা খানিকটা নরম হলেন। উদার গলায় বললেন–মেট্রিক পরীক্ষা আসুক, তখন দেখা যাবে।
শেফু বলল, একটা কিনে দিয়ে দিও বাবা। দাদাভাইয়ের খুব বেশি শখ।
আচ্ছা আচ্ছা দেব। হাতে ঘড়ি পরেই পরীক্ষা দিতে যাবি।
দুবছর পার হল। কয়েকবার মনেও করিয়ে দিলাম। বাবা প্রতিবারই হাসিমুখে বললেন, তাঁর মনে আছে। যথাসময়ে পাওয়া যাবে।
বাবার মধ্যে নাটক করার প্রবণতা আছে। আমি নিশ্চিত, প্রথম পরীক্ষা দিতে যাবার সময় বাবাকে সালাম করব, তিনি পকেট থেকে ঝকঝকে ঘড়ি বের করে দেবেন। এবং হাসতে হাসতে বলবেন–কি খুশি?
প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষা। বাবাকে সালাম করে উঠে দাঁড়ালাম–তিনি বিব্রত গলায় বললেন, বাবা, তুই আমার হাতঘড়িটা নিয়ে যা। কিছু মনে করিস না। টাকা পয়সার খুব সমস্যা যাচ্ছে, কিনতে পারি নি। কি মন খারাপ না তো?
না
মন খারাপ না হলে মুখ এমন অন্ধকার কেন? এই সংসারে ঘড়ি কি খুব বড় জিনিস? দেব, আমি কিনে দেব। খুব দামী ঘড়ি কিনে দেব।
বাবার পাঁচ টাকা দামের ঘড়ি বুক পকেটে নিয়ে পরীক্ষা দিতে রওনা হলাম। হাতে পরার উপায় নেই। বেল্ট বড়, হাতে ঢলঢল করে।
কলেজ জীবনটাও আমার ঘড়ি ছাড়া কাটল। আমার হোস্টেলের খরচ জোগাতেই বাবা তখন হিমশিম খাচ্ছেন। কিছুতেই সামাল দিতে পারছেন না। ঘড়ি আসবে কোত্থেকে!
প্রথম ঘড়ি কিনলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকারও দেড় বছর পর। ইউনিভার্সিটি শীতের বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ হবার দুদিন আগে একসঙ্গে স্কলারশীপের একবছরের টাকা পেয়ে গেলাম। প্রায় হাজারখানিক টাকা! একসঙ্গে এত টাকা? মাথা খারাপ হয়ে যাবার মত অবস্থা। চলে গেলাম ইসলামপুর। সেই সময়কার হিসেবে সবচে দামী হাত ঘড়িটা কিনলাম। সাড়ে তিনশ টাকা। খুব সহজ ঘড়ি না। বিশেষ ধরনের জিনিস। একের ভেতর দুই। একটা স্টপ ওয়াচও আছে। স্টপ ওয়াচের উপকারিতা এখনো বুঝতে পারছি না। আপাতত কতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখা যায় সেই পরীক্ষা চলছে। হাতে পরেছি, হাত কেমন ভার ভার লাগে। মনে হয়। অন্য মানুষের হাত। দশ মিনিট পরপর সময় দেখতে ইচ্ছে করে। পাশ দিয়ে ঘড়ি-পরা কেউ যাচ্ছে, আমি গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করি, ভাই কটা বাজে?
সে হয়ত বলল, দুটা দশ।
আমি চট করে নিজের ঘড়ি দেখে নেই–হ্যাঁ, আমারটাতেও দুটা দশ বাজে।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘড়ি কেনার আনন্দ অনেকখানি কমে গেল। কেবলি মনে হতে লাগল, খুব একটা ভুল কাজ করেছি। বাবা যখন দেখবেন আমি নিজের টাকায় ঘড়ি কিনেছি তখন তিনি নিশ্চয়ই মন খারাপ করবেন। অক্ষমতার কষ্ট খানিকটা হলেও পাবেন। তাঁকে সেই কষ্ট দেবার কোন অধিকার আমার নেই। ঘড়ি ফিরিয়ে দেয়া যায়। দোকানি বলে দিয়েছে–পছন্দ না হলে ফেরত নেবে। রিসিট সঙ্গে থাকলেই হল। অল্পবয়সের লোভই জয়ী হল। ফেরত দেয়া হল না। আর ফেরত দেবই বা কিভাবে? কি চমৎকার জিনিস! একের ভেতর দুই।
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেল। রাত দশটার বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে চেপে রওনা হলাম। যাচ্ছি বগুড়া। তখন আমার বাবা-মা থাকতেন বগুড়া।
জানালার পাশে বসেছি। ঘড়িপরা হাত বাইরে বের করা–গফরগাঁ রেল স্টেশন থেকে গাড়ি ছেড়েছে। হঠাৎ তীব্র ব্যথায় আমার বাঁ হাত অবশ হয়ে গেল। কোন এক হৃদয়হীন মানুষ টান দিয়ে ঘড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে–হাত কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। হাতের ব্যথায় নয় প্রবল অভিমানে আমার চোখে পানি এসে গেল। অভিমান ভালবাসার মত, কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমার বেলায় হল। আমি আর ঘড়ি কিনলাম না।
বিয়ের পর হাতে ঘড়ি নেই দেখেই হয়ত আমার শ্বশুর সাহেব তার কন্যার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন আমাকে ঘড়ি কিনে দিতে। আমার সংসারে তখন চরম অভাব। মহা সংকট। আমি গুলতেকিনকে বললাম, ঘড়ি জিনিসটা আমার খুবই অপছন্দ।
সে বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
দেখছ না সব সময় টিকটিক করে মনে করিয়ে দিচ্ছে–সময় ফুরিয়ে গেল। এই জন্যে ঘড়ি দেখলেই আমার গা জ্বালা করে।
সেই সময় আমি যা বলতাম গুলতেকিন বিশ্বাস করত। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সবচে জ্ঞানী (!!) মানুষটিকে সে বিয়ে করেছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে জ্ঞানী (!!) মানুষটির রুচি এবং অভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। সে বলল, টাকাটা তাহলে কি করব? বাবাকে ফিরিয়ে দেব?
পাগল হয়েছ? উনাকে ফেরত দিলে উনি অপমানিত বোধ করবেন না? আমার কাছে দাও, আমি খরচ করি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যখন আমেরিকা যাচ্ছি তখনো আমার হাতে ঘড়ি নেই। অবশ্যি ততদিনে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। সময় বোঝা আমার জন্যে। কোন সমস্যাই না।
নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ ডি করছি–আমার এক বন্ধু শ্রীলংকার রত্ন সভাপতি সুরিয়াকুমারণ একদিন হতভম্ব হয়ে বলল, আমেরিকার মত জায়গায় তুমি ঘড়ি ছাড়া চলছ, ব্যাপারটা কি?
আমি বললাম, সময় জানা আমার কোন সমস্যা না। তুমি আমাকে সময় জিজ্ঞেস কর, আমি বলে দেব।
দশ ডলার বাজি?
হ্যাঁ, দশ ডলার। এখন বাজছে একটা কুড়ি।
সুরিয়াকুমারণ তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। আসলেই একটা কুড়ি। পাঠকদের কাছে ব্যাপারটা যতটা রহস্যময় মনে হচ্ছে আসল ঘটনা তেমন রহস্যময় নয়। কিছুক্ষণ পরপর অন্যের হাতঘড়িতে সময় দেখে নেয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সুরিয়াকুমারণের হাতঘড়িতে কটা বাজে তা তার সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র এক ফাঁকে দেখে নিয়েছিলাম।
আমার ৩২তম জন্মদিনে আমার স্ত্রী তার বেবী সিটিং-এর টাকায় আমাকে অত্যন্ত দামী একটি সিকো ঘড়ি কিনে দিল। হাসতে হাসতে বলল, এটা কোয়ার্টজ ঘড়ি। টিকটিক করে বলবে না–সময় শেষ। নাও, হাতে পর। এই ঘড়ি আমি অনেক কষ্টের টাকায় কিনেছি।
ঘড়ির উপর থেকে অভিমান উঠিয়ে নিয়ে প্রথম হাতঘড়ি পরলাম। নিজেকে কেন জানি অন্যমানুষ, অন্যমানুষ মনে হতে লাগল। প্রথমবারের মত মনে হল, আর আমাকে অন্যের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
আমার এই সিকো ঘড়িটির বয়স এখন দশ। এখনো চমৎকার সময় দিচ্ছে। তবে এই ঘড়ির একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে–যখন আমার স্ত্রী কোন কারণে আমার উপর রাগ করে–ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা একবার না, আমি অসংখ্যবার লক্ষ্য করেছি।
গুলতেকিন রাগ করে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। একদিন দুদিন কাটে। ঘড়ি হঠাৎ এক সময় আপনা-আপনি চলতে শুরু করে। আমি হাসিমুখে বাড়ি ফিরি। জানি, গুলতেকিনের রাগ পড়ে গেছে। ঘরে ফেরামাত্রই সে বলবে–চা খাবে? চা বানিয়ে এনে দেব?
সুইস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন একটা ছবি বানাবে–বাংলাদেশের কৃষক পরিবার নিয়ে ছবি। তাদের জীবনচর্যার গল্প।
এই ছবি বানানোর সঙ্গে বেশ ভালমত জড়িয়ে পড়লাম। কাহিনী আমার। পরিচালনা টেলিভিশনের খ্যাতিমান পরিচালক নওয়াজীশ আলি খানের। ক্যামেরার দায়িত্ব নিলেন মিশুক চৌধুরী, শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ছবির ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ। মূল চরিত্র ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর এবং আবুল খায়ের করবেন। অয়োময়ের লাঠিয়াল মোজাম্মেল হোসেন সাহেবও রইলেন। মোটামুটি শক্ত টিম। তিনজন শিশুশিল্পীও নেয়া হয়েছে। তারা ডলি জহুরের তিন কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করবে। এই তিন শিশুশিল্পীও দেখা গেল অভিনয়ের ব্যাপারে প্রথম শ্রেণীর।
দলবল নিয়ে আমরা চলে গেলাম ময়মনসিংহ। পুরো শুটিং হবে আউটডোরে। জয় বাংলা বাজারে হতদরিদ্র এক কৃষক পরিবারের বসতবাড়ি আমরা দশ দিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে নিলাম। তারা বাড়ি-ঘর, হাঁস-মুরগি ফেলে অন্যত্র চলে গেল। আমরা সেই সবই একটু এদিক-ওদিক করে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়ে নিলাম।
বিপুল উৎসাহে কাজ শুরু হল।
রাতের বেলা থাকি একটা ডাকবাংলোয়। ডাকবাংলোটা শহর থেকে দূরে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশে। ভারী সুন্দর। সকালবেলা চলে যাই শুটিং স্পটে। কখনো রাত একটা দুটোর আগে ফেরা হয় না। এই জাতীয় কাজ বাইরে থেকে দেখতে খুব একঘেঁয়ে এবং বিরক্তিকর মনে হতে পারে কিন্তু যারা কাজটা করেন তাঁদের আগ্রহ এবং আনন্দ থাকে সীমাহীন। একটামাত্র ক্যামেরায় কাজ হচ্ছে। প্রতিটি জিনিস বারবার খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। একটা টেকের জায়গায় দশটা টেক নেয়া হচ্ছে। যেন প্রথম শ্রেণীর ছবি তৈরি হয়। কোন খুঁত যেন না থাকে।
প্রথম দিনের ঘটনা। আমরা সবকিছু এখনো গুছিয়ে উঠতে পারি নি। ক্যামেরা এসেছে, লাইট ঢাকা থেকে এখনো পৌঁছে নি। লাইটের জন্য অপেক্ষা। আমরা ডাকবাংলোয় আছি। দুপুরের দিকে স্পটে যাব। সরকারী নাশতা তৈরি হচ্ছে। সময় লাগবে। চায়ের প্রবল তৃষ্ণা বোধ করছি। বাইরের কোন দোকানে চা পাওয়া যায় কি-না সেই খোঁজে বের হয়ে পড়লাম। জায়গাটা শহর থেকে দশ মাইল দূরে। দোকানপাট কিছু নেই। অনেক খুঁজে খুঁজে খুপসি চায়ের দোকান একটা পাওয়া গেল। আমি এত দরিদ্র চায়ের দোকান দেখি নি। তার সমল হচ্ছে তিনটি মাত্র চায়ের কাপ এবং কাঁচের বৈয়ামে ভরা গোটা পাঁচেক টোস্ট বিসকিট। দেখেই মনে হচ্ছে মাস তিনেক আগে কিনে বৈয়ামে ভরা হয়েছে। কাস্টমার জুটে নি। ভবিষ্যতে জুটবে তাও মনে হচ্ছে না। খালি গায়ে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পরে দোকানের মালিক বসে আছে। তার পাশে চার-পাঁচ বছর বয়েসী ফুটফুটে একটা মেয়ে। তারও খালি গা। এই দোকানের আয়ে ওদের সংসার কিছুতেই চলতে পারে না।
আমি বললাম, চা খাওয়াতে পারবেন?
জ্বী পারব। বসেন। এটু দিরং হইব। চুলা নিভা।
লোকটা একটা টুল এনে দোকানের বাইরে রেখে অতি যত্নে গামছা দিয়ে মুছে দিল। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। সবরকম প্রতীক্ষাই কষ্টকর কিন্তু চায়ের প্রতীক্ষায় আনন্দ আছে। আমি দেখলাম বাপ-মেয়ে দুজনই মহা উৎসাহে চুলায় আগুন ধরাবার চেষ্টা করছে। দুজনই মনে হচ্ছে আনাড়ি। দুজনই দুজনকে ধমকাচ্ছে। প্রচুর ঠু, খবরের কাগজে প্রচুর বাতাসের পর আগুন ধরল। কেতলি চাপিয়ে দেয়া হল। আমি শুনলাম, মেয়েটি তার বাবাকে ক্ষীণ স্বরে বলছে, আমারে এক কাপ চা দিবা বাজান?
বাবা মেয়েকে চাপা ধমক দিল, এক কাপ চা এক টেকা। চিনি লাগে, দুধ লাগে। চুপ কইরা বইয়া থাক।
আমি লোকটিকে বললাম, ভাই আমাকে দুকাপ চা দেবেন।
জ্বি আইচ্ছা স্যার। আর দেরি নাই, হইয়া আসছে।
দুকাপ চা ছোট মেয়েটি আমার কাছে নিয়ে এল। আমি এক কাপ হাতে নিয়ে তাকে বললাম, এই চা তোমার জন্য। নাও, খাও।
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বললাম, বোস এই টুলটায়। এসো, এক সঙ্গে চা খাই।
মেয়েটা আমার পাশে বসল এবং খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বড়দের মত চা খেতে লাগল। আমি আড়চোখে মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়। মনে হচ্ছে তার দীর্ঘ জীবনে এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে নি। অথচ আমি যা করেছি অন্য যে-কেউ তাই করত। আমি হয়ত একটু বেশি করেছি। চা খাবার জন্য মেয়েটিকে আমার পাশে বসিয়েছি। কিন্তু তার জন্যে এতটা বিস্মিত কেউ হবে! আমার নিজের খানিকটা অস্বস্তি লাগতে লাগল।
চায়ের দাম দেবার সময় বললাম, আপনার চা ভাল হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে আপনার দোকানে এসে চা খেয়ে যাব।
লোকটা বিড়বিড় করে বলল, আপনের যখন মনে চায়, আসবেন। নিশুতি রাইতেও যদি আপনে আমার দোকানের সামনে আইসা মেকু বইল্যা ডাক দেন।
আমি আপনেরে চা বানায়ে দিমু।
কি বলে ডাকতে হবে?
মেকু। আমার নাম মেকু। আমি এই দোকানেই মেয়েরে নিয়া ঘুমাই।
আচ্ছা, আমার জানা রইল। গভীর রাতে যদি চায়ের পিপাসা পায় আমি আপনার দোকানের সামনে এসে মেকু বলে ডাক দেব।
দুপুরের দিকে স্পটে চলে গেলাম। প্রথমদিনে রাত দুটা পর্যন্ত কাজ হল। কাহিনীর বড় অংশই রাতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাইটিং দেখতে হচ্ছে। বৃষ্টির রাত আমাদের যেমন দরকার, চাঁদনি রাতও দরকার।
রাত তিনটায় ডাকবাংলোয় ফিরে এলাম। নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, চা খাবেন না-কি?
তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, রাত তিনটার সময় কে আপনাকে চা বানিয়ে দেবে? সব সময় রসিকতা ভাল লাগে না।
আসুন, খুঁজে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা। গরমও পড়েছে। খোলা হাওয়ায় হাঁটাহাঁটি করলে ভাল লাগবে।
উনি বের হলেন। মোজাম্মেল সাহেবও এলেন। আমরা চায়ের সন্ধানে যাচ্ছি। শুনে আবুল খায়েরও লাফিয়ে উঠলেন। যে কোন ধরনের অ্যাডভেনচারে এই মানুষটির প্রবল উৎসাহ।
আমি তাঁদের দোকানের সামনে নিয়ে গেলাম। দোকান বন্ধ। ঝাপ ফেলা। আমি তিনবার ডাকলাম–মেকু, মেকু, মেকু।।
ঝাঁপ খুলে মেকু এবং মেকু-কন্যা বের হয়ে এল। কেউ কোন কথা বলল না। সবার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রবল উৎসাহে চুলা ধরাতে শুরু করল। নওয়াজীশ ভাই বললেন, ব্যাপারটা কি বলুন তো?
আমি উদাস গলায় বললাম, ব্যাপার কিছু না। ঐ লোকটার নাম মেকু। আমি মেকুর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় চলে এসেছি। যখনি চা খেতে ইচ্ছা হবে, এই দোকানের সামনে এসে তিনবার মেকু বললেই চা চলে আসবে।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম ঘটনাটায় সবাই মজা পাবেন। দেখা গেল, যতটা মজা পাবেন বলে আমি ভেবেছিলাম তাঁরা তার চেয়েও দশ গুণ বেশি মজা। পেলেন। ডাকবাংলোয় ফিরে শুধু মেকুর গল্প।
মোজাম্মেল সাহেব গল্প বলার ব্যাপারে খুব পারদর্শী। তিনি চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে বলছেন,
অদ্ভুত কাণ্ড। জনমানব নেই। নিশুতি রাত। একটা বন্ধ ঘরের সামনে হুমায়ূন ভাই গিয়ে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় তিনবার বললেন–মেকু মেকু মেকু–ওমি চিচিং ফাঁক–দোকানের ঝাপ খুলে গেল।
মেকু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। পরদিন ভোরেই আসাদুজ্জামান নূর গেলেন মেকুকে দেখতে। এক কাপ চা খেয়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলেন। মেকু লজ্জিত গলায় বলল, অত বড় নোটের ভাঙতি নাই।।
নূর বললেন, ভাঙতি দিতে হবে না। এটা আপনি রেখে দিন। আমি হচ্ছি জমিদার মানুষ–ছোট মির্জা। আপনি বোধহয় আমাকে চেনেন না।
জ্বে-না।
টেলিভিশন দেখলে বুঝতেন যে পঞ্চাশ টাকা ছোট মির্জার হাতের ময়লা। টেলিভিশনে কখনো দেখেন নি?
জে-না।
পরদিন রাতের কথা। আমাদের মেকাপম্যান উত্তম খুব বেজার মুখে আমাকে এসে বলল, স্যার আপনের কথা তো ঠিক না।
কোন্ কথাটা ঠিক না?।
আমি ঐ দোকানের কাছে গিয়ে অনেকবার মেকু বলে ডাকছিলাম। কেউ ঝাঁপ খুলল না।
চলুন তো ভাই যাই–দেখি কি ব্যাপার।
আবার আমার সঙ্গে একটা দল জুটে গেল। আমি তিনবার মেকু বলতেই ঝাঁপ খুলে গেল। পিতা-কন্যা ঝাপিয়ে পড়ল চুলা ঠিক করতে। বোঝা গেল–মেকু অন্য কারো ডাকে ঘরের ঝপ খুলবে না। ডাকতে হবে আমাকে। এই বিশেষ ব্যবস্থাটা শুধুমাত্র আমার জন্যই। অন্য কারো জন্যে নয়।
কদিন মেকু খুব জমজমাট ব্যবসা করল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবাই চা খেয়ে আসছে। নওয়াজীশ আলি খান মেকুকে একটা লুঙ্গি কিনে দিলেন।
আমাদের যাত্রার সময় হয়ে এল। শেষ চা খেতে গিয়েছি। প্রথমবারের মত এবারো একা একা গেলাম।
মেকু বলল, শুনলাম আইজ রাইত যাইতেছেন গিয়া।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আপনে যদি মনে কিছু না নেন, আমি আফনেরে এক কাপ চা খাওয়াইতে চাই। এটু ইজ্জত করতে চাই।
মনে কিছু করব না। ইজ্জত করুন।
মেকু চা বানাল। গ্লুকোজ বিসকিটের একটা প্যাকেট ছেঁড়া হল। সম্ভবত ইজ্জত করার উদ্দেশ্যেই প্যাকেটটা কেনা হয়েছে। আমি চা খেলাম, বিসকিট খেলাম।
চলে আসবার সময় লক্ষ্য করলাম মেকু বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ বসে আছে। বাচ্চা মেয়েটি হঠাৎ উঠে এসে পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করে চোখ মুছতে লাগল। এই মেয়েটির সঙ্গে আমার একবারই কথা হয়েছে। আর কখনো কোন কথা হয় নি। আমি বলেছিলাম, বসো আমার পাশে, এসো একসঙ্গে চা খাই। অথচ আজ তার চোখে পানি এসে গেল। কি এমন করেছি আমি? আমি তো মেয়েটার নামও জানি না। একবার ইচ্ছা হল ফিরে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করি। পরমুহূর্তেই মনে হল–কি দরকার?