আত্মা, পরলোক, প্ল্যানচেট, মিডিয়াম ও জন্মলাভ নিয়ে ভারতের জনপ্রিয়তম বইটি নিঃসন্দেহে স্বামী অভেদানন্দের ‘Life beyond Death’ এবং এই বইটিরই বাংলা অনুবাদ ‘মরণের পারে’। জন্মান্তরে বিশ্বাসীদের কাছে অভেদানন্দের বই দুটি গীতা, বাইবেল ও কোরাণের মতোই অভ্রান্ত। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ জাতীয় বহু সেমিনার অথবা আলোচনাচক্রে যোগ দিয়ে শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছি- (১) স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘মরণের পারে’-তে আত্মার অস্তিত্বের কথা বলেছেন, তাঁর বক্তব্য কি তবে মিথ্যে? (২) ‘মরণের পারে’-তে আত্মার যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে তা কি মিথ্যে? (৩) স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বইতে এক রকম যন্ত্রের কথা বলেছেন, যার সাহায্যে আত্মার ওজন নেওয়াও সম্ভব হয়েছে এরপরও কি বিজ্ঞান আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে? (৪) মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে আসা কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন তাঁরা এই পদার্থটির নাম দিয়েছেন, ‘এক্টোপ্লাজম’কে স্বীকার করে নিচ্ছে, সেখানে আপনি আত্মার অস্তিত্বকে না মানার পিছনে কি যুক্তি দেবেন?
অহরহ এই ধরনের বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে আমাকে। স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বইতে ঠিক কি বলেছেন, তাঁর বইতে ঠিক কি বলেছেন, তাঁর মতামত কতখানি বিজ্ঞানগ্রাহ্য, এবং ‘বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে’ বলে স্বামী অভেদানন্দ যা দাবি করেছেন, তা কতখানি
সত্যি- এ বিষয়ে আলোকপাত করা খুবই প্রয়োজন, কারণ, (১) দীর্ঘ বছর ধরে বই দুটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। (২) লক্ষ লক্ষ পাঠক-পাঠিকা স্বামী অভেদানন্দের ধারণাকেই সত্যি ও বিজ্ঞানগ্রাহ্য বলে মনে করে আসছেন।
আসুন, আমরা খোলা মনে যুক্তিবাদী মন নিয়ে দেখি ‘মরণের পারে’ বইটিতে আত্মার বিষয়ে কি কি বলা হয়েছে এবং সেগুলো কতটা যুক্তিসঙ্গত।
স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ বইটির ত্রয়োদশ পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দে। প্রকাশক- শ্রীরামকৃষ্ণের বেদান্ত মঠ। প্রথম পাতাতেই লেখা হয়েছে – মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)
বৈজ্ঞানিক আলোচানমূলক এই অমূল্য গ্রন্থটির ২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- বিশেষ ক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যে যন্ত্রটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার “ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ”।
আত্মার ওজন নেওয়ার যন্ত্র যদি আবিষ্কৃত হয়েই থাকে, তাহলে তো ল্যাঠাই চুকে যায়। এর পরেও আত্মার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কোন বিজ্ঞানমনস্ক? কোন যুক্তিবাদী?
বিজ্ঞান কিন্তু এমন কোনও যন্ত্রের অস্তিত্বের কথা আজও জানে না। স্বামী অভেদানন্দও জানাননি যন্ত্রটির নাম। এই বিষয়ে পরামনোবিজ্ঞানীরাও রা কাড়েননি। অথচ বাস্তবিকই এমন জব্বর আবিষ্কারের খবর শোনার পর আমার অনন্ত
জানতে ইচ্ছে করে আত্মা অর্থাৎ মনের ওজন মাপা সূক্ষ্ম যন্ত্রটির নাম, তার আবিষ্কারকের নাম, কত সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল, আবিষ্কারক কোন দেশের লোক ইত্যাদি বহু প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু উত্তর কে দেবেন? কোনও পরামনোবিজ্ঞানী না, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ?
শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ডাহা মিথ্যে ছেপে দিয়ে খালাস। তাদের উত্তর দেওয়ার দায় নেই। আমি ওদের চিঠি দিয়েও উত্তর পাইনি। আপনারাও চিঠি দিয়ে দেখতে পারেন – কোনও উত্তর আসবে না।
স্বামী অভেদানন্দের ধারণায় আত্মার রূপ বায়বীয় বা কুয়াশার মতো বাষ্পীয়। তিনি বলেছেন, রমণের সময় দেহ থেকে যে একপ্রকার সূক্ষ্ম-বাষ্পীয় পদার্থ নির্গত হয়ে যায় তা জ্যোতিষ্মান। ঐ জ্যোতিষ্মান পদার্থটির ফোটোগ্রাফ বা ছবি তোলা হয়েছে এবং সূক্ষ্মদর্শীরা মরণের সময় দেহ থেকে ওটিকে বার হয়ে যেতেও দেখেছেন। তখন সারা দেহটি এক বিভাময় কুয়াশার পরিমণ্ডলে আচ্ছন্ন হয়।“ (পৃঃ ২৮)
মরণের সময় প্রতিটি দেহ থেকেই যখন কুয়াশার মতো আত্মা বেরিয়ে এসে মৃতদেহটিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তখন সকলেই কেন এই আত্মাকে দেখতে পায় না? উত্তরে অবশ্য স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, সূক্ষ্মদর্শীরা দেখতে পান। অর্থাৎ আমরা সাধারণেরা সূক্ষ্মদর্শী নই, তাই দেখতে পাই না।
স্বামী অভেদানন্দ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন ফোটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়।“ (পৃষ্ঠা-২৮)
কুয়াশার মতো আত্মার ফোটোগ্রাফ কি সাধারণ ক্যামেরাতেই নেওয়া যায়? আর তা যদি না হয়, তবে অসাধারণ ক্যামেরাটার নাম কি? অবশ্য বইটা আগাগোড়া পড়ে এবং বইয়ের প্রকাশকাল দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি খুব বেশি হলে তখনকার দিনের একটু ভালো ধরনের ক্যামেরার কথা বলেছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার একটু ভালো ধরনের ক্যামেরার লেন্স এমন কিছু শক্তিশালী ছিল না। ফলে ক্যামেরার লেন্সে যে কুয়াশাময় আত্মা ধরা পড়ে, তা সাধারণের দৃষ্টি ধরা পড়ে না – এ একেবারেই অসম্ভব।
ক্যামেরায় আত্মার ছবি তোলার গপ্পো আড্ডায় বলা চলে কিন্তু বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায় না। আর, এই সত্যটা পরামনোবিজ্ঞানীরা বেশ ভালোই বোঝেন।
কুয়াশাময় আত্মার কথা বলতে গিয়ে স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, “একটি মেয়ের ঘটনা আমার মনে আছে- কয়েক বছর আগে লস এঞ্জেলস-এ তার ভাই মারা যায়। এ’কথাটি আমি অবশ্য শুনেছি তার মার কাছ থেকে। ভাই যখন মারা যাচ্ছে মেয়েটি তখন মৃত্যুশয্যায় বসে। সে বলে উঠল তার মাকে, ‘মা, মা দেখ – ভাইয়ের দেহটার চারদিকে কেমন একটি কুয়াশাময় জিনিস? কি ওটা?’ মা কিন্তু তার কিছুই দেখতে পেল না।“
ছোট মেয়েটি কুয়াশার মতো জিনিসটা দেখেছিল, সেটা যে আত্মা, তাই বা কি করে স্বামী অভেদানন্দ ধরে নিলেন? স্বামীজি এও বলেছেন, মৃতের মা কিন্তু ওই কুয়াশা দেখেনি। মেয়েটি সত্যিই যদি ওই ধরনের কিছু দেখে থাকে তবে তা visual hallucination (অলীক স্পর্শানুভূতি)। Illusion ও hallucination নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি বলে আবার দীর্ঘ আলোচনায় গেলাম না।
এরপরেও কেউ যদি বলেন, স্বামী অভেদানন্দের আত্মার দর্শন ও আত্মার স্পর্শ পাওয়ার ব্যাপারটা illusion বা hallucination ছিল না, তবে আমাকে একান্ত বাধ্য হয়ে অপ্রিয় সত্যি কথাটাই উচ্চারণ করতে হবে – এই ধরনের ঘটনার পেছনে আর দুটি মাত্র কারণ থাকতে পারে; (১) কেউ স্বামীজিকে ঠকিয়ে কৌশলের সাহায্যে কুয়াশার আত্মা দেখিয়েছে। (২) স্বামীজি আমাদের সঙ্গে বাজে রসিকতা করে গপ্পো লিখেছেন।
আত্মার কুয়াশাময় রূপের প্রমাণস্বরূপ স্বামী অভেদানন্দ এক্স-রে ছবির কথাও বলেছেন। তাঁর কথায়, “আমার দেহের কোন অংশ যদি বা রঞ্চনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব – হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণা পরিপূর্ণ, চারিদিকে যেন তার ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়ম তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ।“ (পৃষ্ঠা – ৩২)
এখানেও কিন্তু স্বামী অভেদানন্দ বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলোকে, না জেনেই অনেক কিছু লিখে ফেলে গোল পাকিয়েছেন। শরীরের হাড়, মাংস, পেশী ইত্যাদির ঘনত্বের বিভিন্নতার জন্য এক্স-রের ছবিতে সাদা-কালো রংগের গভীরতারও বিভিন্নতা দেখা যায়। আর, এই রঙ্গের গভীরতার বিভিন্নতাকেই ‘মেঘের মতো কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ’ বলে ভুল করেছেন স্বামীজি।
স্বামী অভেদানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের আত্মায় বিশ্বাসীরা আত্মাকে বায়বীয় বা কুয়াশার মতো কিছু ভাবলেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের আত্মায় বিশ্বাসীরা কিন্তু আত্মাকে বায়বীয় বলে মনে নিতে রাজি নয়। মালয়ের বহু মানুষের বিশ্বাস আত্মার রং রক্তের মতোই লাল, আয়তনে ভুট্টার দানার মতো। প্রশান্ত-মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা আত্মা তরল। অস্ট্রেলিয়ার অনেকেই মনে করেন আত্মা থাকেন বুকের ভেতর হৃদয়ের গভীরে, আয়তনে। অবশ্যই খুব ছোট্ট। অনেক জাপানীর ধারণা – আত্মার রং কালো।
একবার ভাবুনতো, আত্মার চেহারাটা কেমন, তাই নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশবাসীর বিভিন্ন মত। অথচ স্বামী অভেদানন্দই এক জায়গায় বলেছেন, “আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, সত্য কখনো দু’রকম বা বিচিত্র রকমের হয় না, সত্য চিরকালই এক ও অখন্ড।“ (প্রিষ্ঠা – ৩১)
তবে কেন আত্মার গঠন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ধরনের? কেন এক ও অখন্ড নয়? বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই বিশ্বাসগুলো যার যার ধর্মের নিজস্ব বিশ্বাস। এই সব বিশ্বাসের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
স্বামী অভেদানন্দ জানিয়েছেন – বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, এবং ঐ “বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘এক্টোপ্লাজম’ বা সূক্ষ্ম-বহিঃসত্তা। একটি বাষ্পময় বস্তু এবং এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। এঁকে দেখতে একখন্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার এ নিতে পারবে না।“ (পৃষ্ঠা – ২৮-২৯)
দুটো কথা স্পষ্ট করে বলে নিই (১) বিজ্ঞান কুয়াশার মতো আত্মার অস্তিত্বকে আদৌ স্বীকার করেনি। (২) বিজ্ঞান এই অস্তিত্বহীন কুয়াশার মতো আত্মাকে ‘এক্টোপ্লাজম’ নামে অভিহিত করেনি।‘ ‘এক্টোপ্লাজম’ (Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা কোষ-এর (cell-এর) বাইরের দিকের অংশকে বোঝান। এমন করে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে নিজের মতকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচার করার অপচেষ্টাকে নিশ্চয়ই একে সৎ প্রচেষ্টাও বলা চলে না।
স্বামীজির কথামতো আত্মা যদি কুয়াশার মতো বাষ্পময় বস্তুই হয়, তবেতো খাদ্যে বিষক্রিয়ায় একই বাড়িতে বা একই পাড়ার অনেকে মারা গেলে চারিদিকে কুয়াশাময় হয়ে যাওয়া উচিৎ। কোনও ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের পর সেখানে মৃত শরীরগুলো ঘিরে থাকা উচিৎ ঘন কুয়াশা, যা মানুষের চোখেও ধরা পড়বে। ধরা পড়বে ক্যামেরার লেন্সে। কিন্তু, হায়, বাস্তবে এর কোনটাই ঘটে না।
স্বামী অভেদানন্দ মত প্রকাশ করেছেন যে, এই কুয়াশার মতো বাষ্পময় আত্মাই আমাদের মন। তাঁর ভাষায়, “আত্মা বা মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত নয়।“ (পৃষ্ঠা – ৯৮)
তিনি আরও বলেছেন, “মন মস্তিষ্ক হতে ভিন্ন কোন বস্তু, মস্তিষ্ক একটি যন্ত্রবিশেষ যাকে ব্যবহার্য করে তোলে বা কাজে লাগায় আত্মা, মন কিংবা অন্যকিছু বস্তু – যাই বল না কেন।“ (পৃষ্ঠা – ৯৭)
তিনি এও বলেছেন – মস্তিষ্ক অস্ত্রোপচার করে ‘মন’ নামের কোনও জিনিস খুঁজে না পেলেই তার অস্তিত্বকে মেনে নিলে; কেননা তুমি যা জানছ ‘মনের বা আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই’ –তাও জানছ মন দিয়ে” – “যদি বল যে মনের বা আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই” তবে সেটা হবে কেমন – যেমন এখনই যদি বল যে তোমার জিহ্বা নেই। আমি কথা কইছি জিহ্বা ব্যবহার করে অথচ যদি বল যে জিহ্বা নেই, তাহলে সেটাতে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হবে। (পৃষ্ঠা – এগারো)
‘মরণের পারে’ গ্রন্থটির ভূমিকায় স্বামী প্রজ্ঞানন্দও মনকেই আত্মা বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ধরনায় ‘ইহলোক – স্থূল ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে, আর পরলোক – সূক্ষ্ম মনের ও মানসিক সংস্কারের রাজ্যে।“
স্বামী প্রজ্ঞানন্দ আরও বলেছেন, “মরণের পারে’ এক রহস্যময় দেশ – যে দেশে সূর্য নাই, চন্দ্র নাই, নক্ষত্র নাই, যে দেশে স্থূল নাই, কেবলই সূক্ষ্ম-ভাবনা ও সূক্ষ্ম-চিন্তার রাজ্য। এই চিন্তার রাজ্যকেই মনোরাজ্য বা স্বপ্নরাজ্য বলে।“ …মনের সেখানে বিলাস-চলা, বসা, খাওয়া, দাওয়া-নেওয়া, এই সমস্ত পরলোকবাসী জীবাত্ম ভোগ করে মনে তাই মনেরই সেটি রাজ্য, মনেরই সেটি লোক।“ (পৃষ্ঠা এগারো)
স্বামী অভেদানন্দ ও স্বামী প্রজ্ঞানন্দের এই কথাগুলো থেকে যে কটা জিনিস স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে, তা হল – (১) আত্মাই মন, মনই আত্মা। (২) মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্ক জাত নয়। (৩) মনের অস্তিত্ব স্বীকার মরা মানেই আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। (৪) পরলোকবাসী আত্মাদের মস্তিষ্ক বলে কোনও পদার্থ না থাকলেও, তারা পরলোকরাজ্যে সূক্ষ্ম-ভাবনা ও সূক্ষ্ম-চিন্তা করে।
দুই স্বামীজির লেখা পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ‘মন’ বিষয়ে তাঁদের প্রাথমিক জ্ঞানটুকু নেই। সবার সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা কখনোই সম্ভব নয়, এই সত্যকে মেনে নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি – ‘বৈজ্ঞানিক আলোচনা’র লেবেল এঁটে সাধারণের সামনে এই ধরনের ভুল ও অসত্য কথা লেখা খুবই অন্যায়।
‘মন’ বিষয়ে আলোচনা করার আগে দুই স্বামীজি যে কোনও চিকিৎসকে জিজ্ঞেস করলেই বা মনোবিজ্ঞানের বই পড়লেই জানতে পারতেন – মন কোনও ‘জিনিস’ নয়, মন বা চিন্তা হল মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। তাই মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করলেও মনকে দেখতে পাওয়া যায় না। তবে দেখতে পাওয়া যায় মস্তিষ্কের কোষগুলোকে, যাদের সংখ্যা দশ লক্ষ কোটি।
‘মন’ বা ‘চিন্তা’ যেহেতু মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল, অতএব মনকে ‘মস্তিষ্ক বহির্ভূত পদার্থ’ বা ‘মস্তিষ্কজাত নয়’ বললে তা হবে চূড়ান্ত মূর্খতা।
মনের অস্তিত্বকে বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা কখনই অস্বীকার করছেন না। কিন্তু মনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া মানেই অমর আত্মার/ অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া বলে যদি স্বামীজি দু’জন মনে করে থাকেন, তবে তা হবে তাঁদেরই অজ্ঞতার পরিচয়। কারণ, বিজ্ঞান মনের অস্তিত্ব বলতে একটা কুয়াশার মতো বাষ্পময় কোন পদার্থকে বোঝে না।
স্বামীজিদের ধারণা মতো আত্মার চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা আছে। অথচ, বিজ্ঞানের সাহায্যে বা সাধারন যুক্তিতে এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ছাড়া চিন্তা বা মনের অস্তিত্ব অসম্ভব এবং অবাস্তব, কারণ চিন্তা বা মনের উৎপত্তি মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষগুলোর ক্রিয়ারই ফল। এ-শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, পোকা-মাকড়, পিঁপড়ে বা আরশোলা, সবার চিন্তা বা মনের ক্ষেত্রেই রয়েছে স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ সবচেয়ে উন্নত, তাই তার চিন্তা ক্ষমতাও সবচেয়ে বেশি। মস্তিষ্ক, স্নায়ুকোষবিহীন যে বাষ্পমায় আত্মার ধারণা স্বামীজিরা করেছেন, সেই আত্মা ব্যক্তিগতভাবে কখনোই চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারে না। এই ধরনের ধারণা একান্তই অবৈজ্ঞানিক, অলীক ও যুক্তিহীন।
বিদেহী আত্মা কিভাবে আবার দেহ ধারণ করে সে বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ যে বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেছেন তা আপনাদের অবগতির জন্য তুলে দিচ্ছি। ‘মন’ বা ‘আত্মা’ “আকাশের মধ্য দিয়ে বায়ুতে প্রবেশ করে, বায়ু থেকে মেঘ, সেখান থেকে বৃষ্টির বিন্দুর সঙ্গে তারা পড়ে ধরণীতে, তারপর কোন খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে আবার তারা জন্ম নেয়।“ (পৃষ্ঠা – ৩৮)
তিনি স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেছেন, “পিতামাতা এই দেহ গঠনের সহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সাহায্যের প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহ গঠনে সমর্থ হয় সূক্ষ্মশরীর। পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষন পর্যন্ত না আত্মা পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।“ (পৃষ্ঠা – ৬২)
স্বামী অভেদানন্দ মানুষের জন্ম সম্বন্ধে যে ধারণা তাঁর অন্তর্ভুক্ত পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন, তা হল (১) বিদেহী আত্মা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে এবং খাদ্যের সঙ্গে মানব দেহে প্রবেশ করে, (২) একজোড়া সুস্থ-সবল ও জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষ ও তাদের দেহ মিলনের সাহায্যে কখনই কোন নতুন মানুষের জন্ম দিতে পারে না। নতুন মানুষটি জন্ম নেবে কিনা তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছার ওপর। বিদেহী আত্মা পুরুষের অভ্যন্তর থেকে নারীর অভ্যন্তরে আবির্ভূত হলে, তবেই সম্ভব এক নতুন মানুষের জন্ম।
ঠিক এই ধরণের বিশ্বাস নিয়েই এককালে ভারতের নারী পুরুষের পরিবার পরিকল্পনার চেষ্টা না করে গাদা গাদা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং আর্থিক চিন্তায় ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বলেছেন, “কি করব, সবই ভগবানের হাত।“
আজকের অধিকাংশ ভারতবাসীই বুঝতে পেরেছেন, “সন্তানের জন্মের পেছনে ভগবানের হাত থাকে না। থাকে নিজেদের সক্ষম সঙ্গম ও জন্ম দেবার ক্ষমতা।
বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে মানুষের জন্ম একটা জৈবিক ব্যাপার। একজন নারী ও একজন পুরুষের দৈহিক মিলনে পুরুষের শুক্রকীট নারীর ডিম্বাণুবাহী নালিকার মধ্যে প্রবেশ করে, সাঁতার কেটে জরায়ুর মধ্যে ঢুকে ওভামের সঙ্গে মিলিত হয়ে গর্ভসঞ্চার হয়, অর্থাৎ সৃষ্টি হয় ভ্রুণের। জরায়ুর মধ্যে ভ্রুণ ধীরে ধীরে লালিত-পালিত হয়ে অবশেষে পৃথিবীর আলো দেখে মানব-শিশু রূপে।
ভ্রুণের মধ্যে স্বামীজি কথিত আত্মা কখন ঢোকে? কিভাবে ঢোকে? আত্মা কি তবে শুক্রকীটের মধ্য দিয়ে নারীর জরায়ুতে সঞ্চারিত হয়? স্বামীজি আত্মার ওজন বলেছেন “প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিন ভাগ।
‘এক আউন্সের তিন ভাগ’ কথাটা নিয়ে একটু গোলমালে পড়েছি। ‘মরণের পারে’ বইটির আগের ‘মুদ্রণগুলোতে ‘তিনভাগ’ কথাটারই উল্লেখ পেলাম। স্বামী অভেদানন্দ সম্ভবত এক আউন্সের চার ভাগের তিন ভাগ বলতে চেয়েছিলেন।
৩/৪ আউন্স বা ১/২ আউন্স ওজনের একটা আত্মা কি শুক্রকীট বা ডিম্বাণুতে থাকতে পারে? একজন সুস্থ সবল পুরুষ সঙ্গমের সময় ১০০ মিলিয়ন বা ৪০০ মিলিয়ন পর্যন্ত শুক্রকীট গর্ভস্থানে নিক্ষেপ করে। এক মিলিয়ন হল দশ লক্ষ। অর্থাৎ একজন পুরুষ প্রতিবার বীর্যপাতে ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি শুক্রকীট নারী গর্ভে নিক্ষেপ করে। সুতরাং একটা শুক্রকীটের মধ্যে ৩/৪ আউন্স থেকে ১/২ আউন্স ওজনের আত্মা উপস্থিতি একটা সোনামুখি সুচের ফুটোর মধ্য দিয়ে একটা হাতি চলে যাওয়ার চেয়েও অবাস্তব কল্পনা।
স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, আত্মাকে ঈশ্বর বা অপর কোন দেবতা সৃষ্টি করেন, হিন্দুরা একথা মানেন না, এই আত্মা আজ অর্থাৎ জন্মহীন, নিত্য, শাশ্বত। (পৃষ্ঠা – ১৮)
বেদান্তে আছে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। নিত্য, শাশ্বত।
৪৭০ কোটি বছর আগে জ্বলন্ত সূর্যের একটি অংশ যখন কোন শক্তিশালী নক্ষত্রের আকর্ষণে বিচ্ছিন্ন হয় তখন এই সব মানুষের মনগুলো কোথায় ছিল? অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থ, জৈব পদার্থ থেকে এককোষী প্রাণী অ্যামিবা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এককোষী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র, যাকে স্বামী অভেদানন্দ বলতে চেয়েছেন মন বা আত্মা। ক্রমবিবর্তনের দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতম স্নায়ুবিশিষ্ট মানুষ।
প্রোকারিয়টস নামের জীবাণুবিশেষ প্রাণী সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে প্রাণেরই মস্তিত্ব ছিল না, তখন মন বা আত্মারা সব কোথায় ছিল?
বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে জড় থেকেই জীবের সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর বিশেষ ভৌত অবস্থায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে। এই প্রাণের পেছনে কোনও মন বা আত্মার অস্তিত্ব ছিল না। প্রাণী সৃষ্টির পর কোটি বছর কেটে গেছে। বিভিন্ন প্রাণীদের বিবর্তনের পথ ধরে মাত্র ২৫ হাজার থকে ৩০ হাজার বছর আগে মানুষ এলো পৃথিবীর বুকে।
৩০ হাজার বছরেরও আগে মানুষের আত্মারা কোথায় ছিল? জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ হল? কেন আত্মারা কীটপতঙ্গ হল? পূর্বজন্মের কোন কর্মফলে এমন হল?
পূর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পিছোতে থাকলে যে প্রাণীতে আত্মার প্রথম জম্মটি হয়েছিল, সেটি কবে হয়ছিল? হলে নিশ্চয়ই এককোষী রূপেই জন্ম হয়েছিল। এককোষী প্রাণীর জন্ম হয়েছিল কোন জন্মের কর্মফলে?
না, এর কোনটারই উত্তর পাবেন না, কারণ, উত্তর দেওয়ার কিছুই নেই।
বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী হোক বা অন্য কোন নক্ষত্রের গ্রহেই হোক, যেখানেই প্রাণী থাকবে সেখানেই এই প্রাণের পেছনে থাকবে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া, কোনও আত্মা নয়।
স্বামী অভেদানন্দ বা বেদান্ত মানুষের আত্মাকে ‘অজ’ অর্থাৎ জন্মহীন বলে। আদি বাইবেলে বলা হয়েছে ঈশ্বর পৃথিবীরই উপকরণ দিয়ে তাঁর নিজের অনুকরণে মানুষকে সৃষ্টি করে নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করেন। অর্থাৎ আত্মার জন্ম দেন। বিভিন্ন ধর্ম আত্মার জন্ম নিয়েও বিভিন্ন ধারণা গরে তুলেছে।
আত্মা ও পুনর্জন্ম বিষয়ে সব ধর্মমতই নিজের বিশ্বাসকে ‘একমাত্র সাচ্চা’ বলে ছাপ মারতে চায়। আপনি এই বিষয়ে কোন ধর্মমতকে বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করবেন? এবং কেন গ্রহণ করবেন? আপনি একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বী, একমাত্র এই যোগ্যতার গুণেই কি আপনার ধর্মের সব ধারণা আপনার কাছে অভ্রান্ত হয়ে যাবে?
মোট প্রাণী ও মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার বছরে এই যে বিশাল প্রাণী সংখ্যার বৃদ্ধির এর অর্থ কি এই নয় যে, আত্মারাও জন্মাচ্ছে বলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে?
আত্মা কি নিজেদের ভাগ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন, “না, তা পারে না।“
আত্মা না জন্মালে, না বাড়লে প্রাণী বাড়ছে কি করে? উত্তর নেই।
স্বামী অভেদানন্দ একটি মারাত্মক বিপজ্জনক কথা বলেছেন, “আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলে মানুষের শিক্ষাদীক্ষা চরিত্রগঠনে প্রভৃতি আর বলে অনুভুত হবে না।“
তিনি এমন অদ্ভুত তথ্যটি আবিষ্কার করলেন কিভাবে? বিশ্বের প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞান, প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষ আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। তাঁরা শিক্ষা দীক্ষায় বা চরিত্রগঠনে আত্মা-বিশ্বাসীদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন?
ভেজালের কারবারি, চোর, ডাকাত, খুনে, ধর্ষণকারী – এদের ওপর সমীক্ষা চালালেই দেখতে পাবেন, এদের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগই আত্মার অস্তিত্বে এবং হিন্দু হলে পরজন্মেও বিশ্বাস করে। কিন্তু এই ধর্মীয় ধারণা কি তাদের পাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে পেরেছে?
আত্মার অস্তিত্বের স্বীকার বা অস্বীকারের ওপর শিক্ষাদীক্ষা বা চরিত্রগঠন নির্ভর করে না। নির্ভর করে সেই দেশের আর্থ-সামাজিক (Socio-economic) এবং সমাজ-সাংস্কৃতিক (Socio-cultural) পরিবেশের ওপর।
স্বামী অভেদানন্দ আরও বলেছেন, “অজ্ঞ শ্রেণির লোকেরা এখনও বিশ্বাস করে না যে, আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং দেহ ব্যতীত তার অস্তিত্ব থাকতে পারে।“ (পৃষ্ঠা – ৮০)
স্বামী অভেদানন্দ কি বলতে চান, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা ও যুক্তিকে বিসর্জন দিয়ে তাঁর কথাকেই অন্ধ-বিশ্বাসে পরম সত্য বলে মেনে নেওয়াটাই বিজ্ঞতার লক্ষণ?