সংসারত্যাগী মানুষদের প্রতি আমি এক ধরনের মুগ্ধতা বোধ করি। এই মুগ্ধতার কারণ সম্ভবত জীবনানন্দ দাসের কবিতা–

অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

কোন্ বিপন্ন বিস্ময়ের কারণে এই সব মানুষ সংসার ত্যাগ করে তা জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্যি এক অর্থে এরা আবার পলাতক মানুষ। সংসার থেকে পলাতক, জীবন থেকে পলাতক। দায়িত্ব থেকেও পলাতক। পলাতক মানেই পরাজিত। পরাজিত মানুষদের প্রতি মমতা কেন থাকবে?

ভবঘুরে মানুষকে এই সমাজ ভাল চোখে দেখে না। গালাগালি অর্থে আমরা ভবঘুরে শব্দটা ব্যবহার করি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমস্ত ধর্ম প্রচারকরাই ভবঘুরে। জৈনধর্মের প্রচারক মহাবীর, শিখগুরু নানক, গৌতম বুদ্ধ–এঁরা কি জন্ম-ভবঘুরে নন?

মহাবীর শুধু যে ভবঘুরে তাই না, সর্বত্যাগী ভবঘুরে। তিনি সমাজ-সংসার সব তো ছেড়েছিলেনই–পরিধেয় বস্ত্রও ছেড়েছিলেন। উলংগ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

ভবঘুরেদের প্রতিও আমার এক ধরনের মমতা আছে। প্রায়ই মনে হয়, কি সুন্দর তাদের জীবন! পাখির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভবঘুরে বীজ সম্ভবত আমাদের সবার রক্তেই খানিকটা আছে। ঘোর সংসার-আসক্ত মানুষও কোন এক বিষণ্ণ। সন্ধ্যায় ক্ষণিকের জন্যে হলেও ভাবে–সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? ঐ যে অন্তর্গত রক্তে বিপন্ন বিস্ময়।

জননী ছবির কাজে যখন ময়মনসিংহে খুব ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছি তখন সালেহ ভাই (একজিকিউটিভ ইনজিনীয়ার, পাবলিক হেলথ) খবর আনলেন–রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান, সংসারত্যাগী সাধু মহারাজ সর্বেশ্বরানন্দ আমাদের ফল খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন। আমরা গেলে তিনি খুশি হবেন।

কারোর তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। সারাদিন শুটিং করে ডাকবাংলোয় ফিরে। সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কেউ যেতে চান না–শুধু আমি প্রচণ্ডরকম উৎসাহী। সংসারত্যাগী একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলা যাবে। আশ্রম দেখা যাবে।

আমার উৎসাহেই শেষ পর্যন্ত জননী ছবির পরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনাব নওয়াজীশ আলি খান উৎসাহী হলেন। অভিনেতা আবুল খায়েরের সর্ববিষয়ে উৎসাহ। তিনিও রওনা হলেন। মোজাম্মেল হোসেন (অয়োময়ের লাঠিয়াল) কোন এক বিচিত্র কারণে আমাকে কোথাও একা ছাড়তে রাজি নন। আমার ধারণা–পরকালে যদি আমাকে দোজখে পাঠানো হয়, মোজাম্মেল সাহেব করুণ গলায় বলবেন, আমার পাপ-পুণ্যের হিসেবের দরকার নেই। হুমায়ূন ভাই যেখানে যাচ্ছেন দয়া করে আমাকেও সেখানে নিন। তিনিও রওনা হলেন।

মহারাজ সর্বেশ্বরানন্দ গেরুয়া বস্তু পরে গেটের কাছে আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রথম দর্শনেই খানিকটা চমকালাম–টকটকে গৌর বর্ণ। কাটা কাটা চেহারা। হরিদ্রা বর্ণের কাপড়ে তাঁকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। সর্বেশ্বরানন্দ হাসিমুখে ভরাট গলায় বললেন, আপনারা এসেছেন। খুব আনন্দ হচ্ছে। সুস্বাগতম।

গেটের ভেতর ঢুকতেই আশ্রমের ছেলেরা উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগল। আশ্রমের নিয়ম-কানুন খুব কড়া। এই সময় তাদের পড়াশোনার সময়। উঁকি-ঝুঁকি দেবার সময় নয়। মহারাজ তাদের দিকে ফিরেও নরম গলায় বললেন, এরা আপনাদের জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনারা কি ভাগ্যবান! যেখানে যান সেখানেই মানুষের মনে আগ্রহ জাগিয়ে তুলেন।

সাধু-সন্ন্যাসীরা কথা বলার বিদ্যায় এত ওস্তাদ হয়, জানতাম না। আমি অবাকই হলাম।

আশ্রম ছোট কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন। ছবি-ছবি ভাব। একটা গাছের শুকনো পাতাও কোথাও পড়ে নেই। মেঝেতে এক বিন্দু ধুলা নেই। মনে হয় হাওয়ায় উড়ে ছোট্ট একটা পাখির পালক পড়লেও কেউ ছুটে এসে তা নিয়ে যাবে।

এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আমার কাছে মেকি মনে হয়। মনে হয়, একদল শুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষের কাছে এসে পড়েছি। যারা ধুলা সহ্য করে না, গাছের শুকনো পাতা সহ্য করে না। পাখির পালক সহ্য করে না।

আমরা সাধুজীর অফিসে বসলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফল খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন–কেন বলুন তো?

সাধুজী কিঞ্চিৎ লজ্জিত গলায় বললেন, আশ্রমের ছেলেদের জন্যে একটা টিভি আছে। টিভিতে অয়োময় নাটকটি আমিও ওদের সঙ্গে দেখেছি। আপনারা

অয়োময়ের সৃষ্টিকর্তা। আপনাদের দেখতে চাওয়াই কি স্বাভাবিক নয়?

না, খুব স্বাভাবিক না–আপনি হচ্ছেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। এইসব পার্থিব বিষয় আপনার মধ্যে কেন থাকবে?

কথাগুলি বেশ কঠিন এবং আমি বলেছিও কঠিন ভাবে। ভেবেছিলাম, সাধুজী রেগে যাবেন। তিনি রাগলেন না, হেসে ফেললেন। আশ্রমবাসী এক ছেলেকে বললেন, এঁদের খাবার দাও।

আবুল খায়ের সাহেব বললেন, সাধুজী, আপনার দেশ কোথায়?

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, সেটা তো ভাই বলব না। সন্ন্যাস গ্রহণের পর সন্ন্যাস-পূর্ব জীবনের কথা বলা নিষিদ্ধ।

খাবার চলে এল। নানান ধরনের ফল-মূল। ভাজা মুড়ি। সন্দেশ। বিরাট আয়োজন। প্রতিটি খাবারই অত্যন্ত সুস্বাদু।

সাধুজী বললেন, এই সব খাবার উপহার হিসেবে পাওয়া। ভক্তরা আশ্রমে আসেন। উপহার নিয়ে আসেন। আপনারা তৃপ্তি করে খাচ্ছেন, দেখতে ভাল লাগছে।

আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমি চা টা আশ্রমের বাইরে গিয়ে খেতে চাই।

কেন?

সিগারেট ছাড়া আমি চা খেতে পারি না। আশ্রমে নিশ্চয়ই সিগারেট খাওয়ার অনুমতি নেই।

সাধুজী এই কথার উত্তরে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন–যে কাজ গোপনে করা যায় সেই কাজ প্রকাশ্যেও করা যায়। আপনি এখানেই সিগারেট খান। কোন বাধা-নিষেধ নেই। একবার আশ্রমের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে কিছু গায়ক-গায়িকা এসেছিলেন। তাঁদের একজন মদ্যপান করতে চাইলেন। আমি ঐ দ্রব্য জোগাড় করে তাঁকে খাইয়েছি।

সিগারেট পানের অনুমতি পাওয়ার পরই সবাই একটা করে সিগারেট ধরিয়ে ঘর অন্ধকার করে ফেললাম। নওয়াজীশ আলি খান, মোজাম্মেল হোসেন দুজনের কেউই সিগারেট খান না–তারাও দেখি সিগারেট ধরিয়েছেন। সম্ভবত তাঁরা এক ধরনের টেনশান বোধ করছিলেন।

মোজাম্মেল হোসেন সাহেব আশ্রমের কাণ্ডকারখানায় খানিকটা হকচকিয়ে গেছেন বলে মনে হল। তিনি ভাবগদগদ গলায় বললেন–মহারাজ, আমি এক গ্লাস জল খাব।

আমি বললাম, ভাই আপনি সারাজীবন পানি খেয়ে এসেছেন এখন হঠাৎ জল খেতে চাচ্ছেন কেন?

সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। আলাপ-আলোচনার প্রাথমিক বাধা এই হাসির তোড়ে কেটে গেল। সাধুজী রামকৃষ্ণের নানান কথা বলতে লাগলেন। সবই খুব উঁচুদরের কথা। দার্শনিক কথা। তিনি যদি তা না করে রামকৃষ্ণের সহজ স্বাভাবিক রসিকতার গল্পগুলি করতেন, ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর অতিসরল উক্তিগুলি করতেন তাহলে সবাই অনেক বেশি উৎসাহিত হত।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের–পরম পুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আমার প্রিয় গ্রন্থের একটি। রামকৃষ্ণের মজার উক্তি, তাঁর হিউমার এবং জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করার অসাধারণ ক্ষমতা সব সময়ই আমাকে মুগ্ধ করেছে।

রামকৃষ্ণের আলোচনা যখন উঠল লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি কয়েকটা গল্প বললাম।

 

রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ঈশ্বর কি?

রামকৃষ্ণ বললেন, বলছি। তার আগে তুই বল, ঘি কি?

ভক্ত বিস্মিত হয়ে বলল, ঘি হচ্ছে ঘি।

রামকৃষ্ণ বললেন, ঈশ্বর হচ্ছে ঈশ্বর।

 

সাধক ভক্ত রামকৃষ্ণকে বললেন, আমি কুড়ি বছর সাধনা করে মহাবিদ্যা আয়ত্ত করেছি।

কি সেই মহাবিদ্যা?

আমি এখন পায়ে হেঁটে নদী পার হতে পারি।

আরে গাধা, একটা পয়সা দিলেই তো খেয়া নৌকার মাঝি তোকে নদী পার করে দেয়। তোর এই সাধনার মূল্য হল এক পয়সা। আসল সাধনা শুরু কর।

.

রামকৃষ্ণ বলছেন–যত মত তত পথ। নদী নানা দিক দিয়ে আসে, কিন্তু পড়ে গিয়ে সেই সমুদ্রে। তেমনি ছাদে নানা উপায়ে উঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি, ঘোরানো সিঁড়ি। ইচ্ছে করলে শুধু একটা দড়ি দিয়েও উঠতে পারো। তবে যেভাবেই ওঠো একটা কিছু ধরে উঠতে হবে। সেই একটা কিছু হচ্ছে ধর্ম। যা তুমি ধরবে, তা বাপু একটু শক্ত করে ধরো। পা পিছলে পড়ে না যাও।

এই আশ্রমের একটা জিনিস আমার পছন্দ হল না–মেয়েদের এখানে স্থান নেই। মেয়েরা সাধনার বাধা। এদের সরিয়ে রাখতে হবে দূরে।

আমি সাধুজীকে বললাম, এ-রকম হল কেন? রামকষ্ণ নিজে তো বিবাহিত ছিলেন।

তিনি বললেন, আশ্রমের নিয়ম-কানুন স্বামী বিবেকানন্দের করা। তিনি ছিলেন চিরকুমার।

আপনি নিজে কি মনে করেন মেয়েরা সাধনার বাধা?

তিনি জবাব দিলেন না।

আমি বললাম, শেষ প্রশ্ন–আপনার কি এই দীর্ঘ সন্ন্যাস জীবনে একবারও মন কেমন করে নি? একবারও ইচ্ছে হয় নি গৃহবাসী হতে?

সাধুজী এই প্রশ্নের জবাবে বললেন, আপনারা কিন্তু আবার আসবেন। চারটা ডাল ভাত আমার সঙ্গে খাবেন। আশ্রমে অতিথিশালা আছে। এর পরের বার এলে উঠতে হবে আমার অতিথিশালায়। মূল প্রশ্ন আবারো এড়িয়ে গেলেন।

আশ্রমের ছেলেরা দল বেঁধে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দ এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম তাদের অনেকের কাছেই আমার মত গৃহী মানুষের লেখা বই।।

ডাকবাংলোয় ফিরে এলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে একটা বেজে গেল। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, আজ একটু নিয়মের ব্যতিক্রম করলে কেমন হয়?

কি রকম?

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চলুন, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাই। একটা নৌকা ভাড়া করে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ঘুরে বেড়াই।

আমি ভেবেছিলাম তিনি রেগে যাবেন, রাগলেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে সহজ গলায় বললেন–চলুন।

মোজাম্মেল হোসেন শুয়ে পড়েছিলেন। তিনি গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিয়ে বললেন, খবর্দার আমাকে ডাকবেন না। আমি এইসব পাগলামিতে নেই। এটা একটা কথা হল রাত একটায় ব্রহ্মপুত্র?

আমি নওয়াজীশ ভাইকে নিয়ে গেট পর্যন্ত চলে গিয়েছি। দেখি ভিজতে ভিজতে মোজাম্মেল সাহেব আসছেন। তিক্ত গলায় বলছেন–কোন মানে হয়? এই পাগলামির কোন মানে হয়?

সারারাত আমরা নৌকায় কাটালাম। খোলা নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে বৃষ্টিতে ভিজলাম। মোজাম্মেল সাহেব একটু পরপর বলতে লাগলেন–অপূর্ব!!

ভোরবেলা মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করল। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, সন্ন্যাসী হয়ে গেলে কেমন হয়?

নওয়াজীশ ভাই বললেন, আমি রাজি। চলুন নৌকা ভাসিয়ে দেই।

আমরা নৌকা ভাসালাম না। তবে সবাই শার্ট খুলে নদীর পানিতে ফেলে দিলাম। নৌকার মাঝি অবাক হয়ে বলল, কি হইছে?–আপনারার কি হইছে?

সে বৈঠা দিয়ে তিনটা শার্টের মধ্যে দুটা শার্ট উদ্ধার করল।

ভোরবেলা ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর নির্মিত চীন মৈত্রী সেতু দিয়ে হেঁটে হেঁটে তিনজন ফিরছি। কারো গায়ে শার্ট নেই। আমাদের ঘোর কেটে গেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। এখন আমাদের চেষ্টা কত দ্রুত আস্তানায় ফিরে ভদ্র হওয়া যায়।

মর্নিং ওয়াক করতে বের হওয়া এক ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। একি সমস্যায় পড়া গেল! আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটছি। ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, আপনি কি হুমায়ূন আহমেদ?

আমি মধুর হেসে বললাম, আপনি ভুল করছেন। আমি অন্য ব্যক্তি।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x