প্রকাশকের কথা

জীবনের সৌন্দর্যে আর মহত্ত্বের সন্ধানে ব্রতী কথাশিল্পী বিচিত্র পরিবেশে তার উদ্দিষ্ট খুঁজে বেড়াবেন এটাইন স্বাভাবিক। আর এক্ষেত্রে হুমায়ুন আহমেদের ঐকান্তিকতা সুপরিজ্ঞাত। বৈচিত্রের এ সন্ধানই তাঁকে নিয়ে যায় ভূত আর অদ্ভূত রসের এক অদ্ভূতুড়ে অঙ্গনে। এই পরিক্রমণের ফসল এ বই-এ সঙ্কলিত সদ্যরচিত গল্প-পঞ্চক। গল্পগুলো কেমন হয়েছে সে রায় দেবেন পাঠকেরা। আমাদের জানিয়ে দেবার কথা একটাই – ভূত আর অদ্ভূত রসে শিশু-পাঠকের স্বত্বেও এ গল্পগুলো রচিত হয়েছে শৈশব পেরুনো সব বয়সের পাঠককে সামনে রেখে।

আনন্দের এ আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানোর সঙ্গে জানিয়ে রাখছি, বইটি আপনাদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমাদের আনন্দ পূর্ণতা পেয়েছে।

আলতাফ হোসেন

গুণীন

তার নাম চান্দ শাহ ফকির।

আসল নাম না–নকল নাম। আসল নাম সেকান্দর আলি। যারা মন্ত্র তন্ত্র নিয়ে কাজ করে তাদের অনেক রকম ভেক ধরতে হয়। নামও বদলাতে হয়। তাদের চাল-চলন, আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের মত হলে চলে না। সাধারণ মানুষের ভয়, ভক্তি, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্যে তাদের সারাক্ষণই নানান চেষ্টা চালাতে হয়।

চান্দ শাহ ফকিরকে দেখে সাধারণ মানুষের ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা কোনটাই হয় না। রোগা, বেঁটে একজন মানুষ। বেঁটেরা সচরাচর কুঁজো হয় না, চন্দ শাহ খানিকটা কুঁজো। হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কারণ বাঁ পা বলতে গেলে অচল। বাঁ পা টেনে টেনে এগুতে হয়। অন্যান্য গুণীনদের মত মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল আছে। চোখও সারাক্ষণই লাল থাকে। গলায় তিন রকমের হাড়, কাঠ এবং অষ্টধাতুর মালা আছে, তারপরেও চান্দ শাহকে সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তাকে চান্দ শাহ ফকির ডাকে না–ডাকে চান্দু। চান্দ শাহ তার স্ত্রীর কাছে এই নিয়ে খুব দুঃখ করে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস চাপতে চাপতে বলে–দেখ বড় মানুষের বিচার। আমি এতবড় একটা গুণীন। পশু-পাখি পর্যন্ত আমারে সমীহ করে। যে গাছের নিচে বসি সেই গাছে পাখ-পাখালি থাকে না। উইড়া চইলা যায়। অথচ নিজ গ্রামের মানুষ আমারে তুচ্ছ করে। সামনে দিয়া যায়, সেলাম দেয় না। আমার যে নাম চান্দ শাহ ফকির, এই নামে ডাকে না, ডাকে চান্দু। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে মারী-মন্ত্র দিয়া এবারে একটা শিক্ষা দেই। জন্মের শিক্ষা।

চান্দ শাহের স্ত্রীর নাম ফুলবানু। সে দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে এখন বিছানায় পড়ে গেছে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই তবে জিহ্বা অত্যন্ত সচল। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে–কি মন্ত্রের কথা কইলেন?

মারী-মন্ত্র। মন্ত্র ঝাড়া মাত্র গ্রামের ঈশাণ কোন থাইকা শুরু হবে রোগব্যাধি–আস্তে আস্তে পুরা গ্রাম। বড় কঠিন মন্ত্র। একবার ঝাড়লে মন্ত্র কাটান দেওয়া মুশকিল। তুমি যদি বল একবার মন্ত্র ঝাড়ি। উচিত শিক্ষা হউক। গ্রামের সব মুরুব্বী যখন পায়ের উপরে উপুড় হয়ে পরব তখন একটা বিবেচনা হবে।

ফুলবানু বলল, এই জাতের কথা বলতে আফনের শরম লাগে না? মন্ত্রের আফনে কি জানেন? কাচকলাটা জানেন।

বউ, কি বললা?

বললাম মন্ত্রের আফনে কাচকলাটা জানেন। আফনে হইলেন ঠগ। বিরাট ঠগ।

ঠগ বললা?

হ্যাঁ বললাম। অহন কি করবেন? বান মারবেন?

বান তো মারতেই পারি। বান মারা কোন বিষয় না। হাতের ময়লা।

মারেন দেখি একটা বান।

চান্দ শাহ হুঁকায় তামাক ভরতে ভরতে বলল, তুমি রোগী মানুষ বইল্যা ছাইড়া দিলাম। না হইলে সরিষা মন্ত্র দিয়া দিতাম। দেখতা, বিষয় কি! হাতের তালুর মধ্যে পাঁচটা কাঁচা সরিষা নিয়া মন্ত্র পড়তে হয়, তারপরে সেই সরিষা ছুইড়া দিতে হয় শইল্যে। সরিষা তো না, সাক্ষাত হাবিয়া দোজখের আগুন। শইলের যে জাগাতে লাগবে সেই জাগাত সাথে সাথে গোল আলুর মত ফোঁসকা। সারা শইল্যেও মনে হইব আগুন জ্বলছে। ইচ্ছা হবে শীতল পানিতে ঝাঁপ দিয়া পড়ি। ঝাঁপ দিয়া পড়লে আরো বিপদ। পানি তখন আগুনের মত। শইল্যে পানি লাগল কি গেল।

দেন না এট্র সরিষা পড়া। আফনের ক্ষমতাটা দেখি। দেখি আফনে কত বড় গুণীন। বিয়ার পর থাইক্যা আমি শুনতাছি–আমার এই ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা, মারী-মন্ত্র, সরিষা মন্ত্র। ভর ভর কইরা বলেন, বলতে শরমও লাগে না। ছিঃ ছিঃ!

রাগ উঠাইও না বউ। রাগ উঠাইলে নিজের ক্ষতি হবে।

আহারে–রাগ উঠাইলে নিজের ক্ষতি হবে! কি আমার উস্তাদ। দুনিয়ার বেবাক মন্ত্র জানে। তার হুকুমে চলে জ্বীন পরী। হেই লোক দুই বেলা ভাত পায় না। আফনের পুষা জিন যেন কয়টা আছে?

তামাক টানতে টানতে চান্দ শাহ উদাস গলায় বলে–আমার পোষা না। আমার বাপজান পুষেছিলেন–এখন আমার দখলে আছে। তিনটার ভেতর একটার মৃত্যু হয়েছে। এখন আছে দুইটা। একজনের নাম দাস্তিন, আরেকজনের নাম নাস্তিন। এরা দুই সহোদর ভাই।

দুই জ্বীন আফনের হুকুমের চাকর। হেই দুই জ্বীনরে দিয়া এক কলসি সোনার মোহর আনাইয়া দেন। যে কয়টা দিন বাচি আরাম কইরা বাচি। ভালমন্দ কিছু খানা খাই। দুই হাতে ছয় গাছি, ছয় গাছি সোনার চুড়ির আমার বড় শখ।

চান্দ শাহ গম্ভীর মুখে বলে, সোনার মোহরের কলসি কোন ব্যাপারই না বউ। জ্বীনেরে আইজ বললে আইজ আইন্যা দিবে। কিন্তু নিষেধ আছে। নিজের লাভের জন্যে কিছু করার উপায় নাই। আমার হাত-পা বান্ধা বউ। তাহলে শোন তোমারে একটা গল্প বলি–আমার পিতার আমলের কথা। উনার যেমন জ্বীনসাধনা ছিল, তেমনি ছিল পরীসাধনা। একটা পরী ছিল ওনার খুব পেয়ারের। তার নাম একরার বেগম। বড় সৌন্দর্য ছিল সে। চান্দের আলোর মত গায়ের রঙ। আহা রে, কি বিউটি!

কানের কাছে ভ্যান ভ্যান কইরেন না। জ্বীনসাধনা পরীসাধনা, ওরে আমার সাধক রে! দূর হন দেখি, দূর হন।

স্ত্রীর কটু কথায় চান্দশাহর মত বড় সাধককে খুব বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে হুক্কা হাতে বাড়ির সামনের উঠানে ছাতিম গাছের নিচে এসে বসে। দিনের বেশিরভাগ সময় এই গাছের নিচেই সে বসে। কিছুদিন আগেও ছাতিম গাছে একটা সাইনবোর্ড ঝুলতো।

চান্দশাহ ফকির
জ্বীনসাধনা, পরীসাধনা,
তাবিজ, যাদু-টোনা, বশীকরণ,
মারণ, উচাটন, কড়ি চালনা,
বাটি চালনা, তেলপড়া, চুনপড়া
(বিফলে মূল্য ফেরত)

রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, তুফানে সাইনবোর্ড পচে গলে গিয়েছে। নতুন সাইনবোর্ড কিনতে একশ কুড়ি টাকা লাগে। এত টাকা চান্দ শাহর নেই। সে হত-দরিদ্র। কাজেই। তাকে এখন মূর্তিমান সাইনবোর্ড হিসেবে বসে থাকতে হয়। বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ গেলে গভীর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে–কে যায়? আজিজ মিয়া না? খবর কি?–বস, দুই একটা গফসফ করি। শরীর ভাল? মুখটা মলিন দেখতেছি কেন?

আজিজ মিয়ার তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। ভিন গ্রামের কেউ গুণীনের খোঁজে এলে চান্দশাহ ফকিরের ভাবভঙ্গি বদলে যায়। সে ভারি গলায় বাড়ির দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়–মোবারক, তামুকে আগুন দেও দেখি। মোবারককে এমিতে তুই তুই করে বলা হলেও এই সময় তার সম্বোধন হয়ে যায় তুমি।

মোবারক চান্দ শাহ ফকিরের সঙ্গে থাকে। ফকিরকে সে মামা ডাকে। তার বয়স এগারো। অকাট গাধা। গাধারা যেমন কাজকর্মে ভাল হয় মোবারকও কাজকর্মে ভাল। রান্নাবান্না, কলসি করে টিউবওয়েলের পানি আনা, হাট-বাজার করা, কাপড় ধোয়া, রোগীর যত্ন–সব সে একাই করে। হাসিমুখে করে। চান্দশাহ ফকির মোবারককে বেতন দেয় না, সেই সামর্থ তার নেই–দুবেলা খাওয়া দিতে পারে না, বেতন তো অনেক পরের ব্যাপার। মোবারকের তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। সে আনন্দেই আছে, কারণ চান্দশাহ ফকিরের আশেপাশে থাকাকেও সে ভাগ্য বলে মনে। চান্দ শাহ ফকির তাকে পছন্দও করে। মন টন খুব উদাস হলে মোবারককে ডেকে বলে–

ও মোবারক! তোর কোন চিন্তা নাই–মন দিয়া কাজকর্ম কর। আমার মৃত্যুর আগে তোরে একটা ফকিরি বিদ্যা দিয়া যাব। সব দিতে পারব না। বড় কঠিন বিদ্যা। তবে একটা পাবি। একটা বিদ্যাই যথেষ্ট। সারা জীবন এই বিদ্যা বেইচ্যা খাবি। সুখে থাকবি। ক দেহি কোন্ বিদ্যা চাস? নখ-পড়া শিখবি? টেলিভিশনের পর্দায় যেমুন ছবি দেখা যায় তেমুন নখের উপরে ফকফকা কালার ছবি দেখবি। তোর রাশিটা কি? তুলারাশি ছাড়া আবার হয় না।

রাশি কি তা তো ফকির মামা জানি না।

আইচ্ছা, দেখব নে পরীক্ষা কইরা। তুলারাশি বইল্যা মনে হয় না। তুই বিরাট গাধা। তুলারাশির মধ্যে গাধা হয় না। যাই হউক, তুই চিন্তা করিস না। জবান যখন দিছি তোরে একটা বিদ্যা দিয়া যাব। কোন বিদ্যা চাস? বল মুখ ফুইট্যা। শরমের কিছু নাই। শরম নারীর ভূষণ, পুরুষের কলংক।

আন্ধাইর মন্ত্র শিখাই দিয়েন।

আবে ব্যাটা তুই কস কি? এই মন্ত্র যারে তারে দেওয়া যায় না। বড় কঠিন। মন্ত্র। দুই বার এই মন্ত্র পইড়া ডাইন কান্দে একবার ফু, বাও কান্দে একবার ফু, বাস, আর দেখা লাগবে না। তুই হবি অদৃশ্য। তুই সবেরে দেখবি, তোরে কেউ দেখব না। তুই হবি অদৃশ্য মানব। এই মন্ত্র যারে তারে দেয়া যায় না–শোন তাহলে একটা গফ–আমার তখন জোয়ান বয়স। বাশখালি অঞ্চলের নামকরা চোর মজনু মিয়া এক রাইতে আমার পায়ে আইস্যা পড়ল। দুইটা মন্ত্র চায়–নিদালী মন্ত্র আর আন্ধাইর মন্ত্র। বলে কি–ফকির সাব, এই দুই মন্ত্র দেন–আর টেকা কি লাগব কন। টেকা কোন বিষয় না। আমি বললাম, এইটা তো হবে না। এই মন্ত্র যার তার হাতে দেওয়া যায় না। ওস্তাদের নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ।

মজুন মিয়া তখন আমারে ভয় দেখায়। বলে কি–মন্ত্র না দিলে ফকির সাব আফনের কিন্তু অসুবিধা হবে। আমি সহজ লোক না। আমি জটিল লোক।

আমি মনে মনে হাসলাম। যার জ্বীনসাধনা তারে ভয় দেখায়। হাতি-ঘোড়া গেল তুল পিপিলিকা বলে কত জল। হায় রে বেকুব–পরের ঘটনা বিরাট ইতিহাস।

ইতিহাসটা কি?

চান্দ শাহ ফকির উদাস গলায় বলে–সব ইতিহাস শুননের দরকার নাই। মোবারক। কাজ কর, কাজ কর। মন দিয়া কাজ করলে তোর গতি করে দিয়ে যাব। চান্দ শাহ ফকির জবান ঠিক রাখে।

ইতিহাসটা জাননের ইচ্ছা হইতাছে মামা।

দিক করিস না মোবারক। কাজ করতে বলছি কাজ কর। গুণীন যারা তারার কথা বলতে হয় কম। কথা বেশি বললে মন্ত্রের জোর কমে। আইজ এক দিনে মেলা। কথা বইল্যা ফেলছি। আর না।

 

কথা বললে যদি মন্ত্রের জোর কমে তাহলে চান্দ শাহ ফকিরের মন্ত্রে কোন জোর থাকার কথা না। কথা বলার কোন সুযোগই সে নষ্ট করে না। অন্য গ্রামের অচেনা কেউ এলে তো কথাই নেই। এ রকম ঘটনা আজকাল ঘটে না। পীর-ফকির গুণীনের আগের রমরমা নেই।

আগে কি দিন ছিল আর এখন কি দিন! চান্দ শাহ ফকির ছাতিম গাছের নিচে বসে বর্তমান দিনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আগের দিনে কথায় কথায় গুণীন ডাকতো। গুণীন ছাড়া সমাজ ছিল অচল।

পাগলা কুকুরের কামড় : হলুদ পোড়া।
সাপের কাটা : কালো তাগা।
জীনের দৃষ্টি : লোহাপড়া। সোলেমানী তাবিজ।
ভুতের বাতাস : সরিষা পড়া।
পরীর নজর : বাড়ি বন্ধন।
চোরের উপদ্রব : কণ্টক মন্ত্র।
নয়া আবু রাতে ঘুমায় না, চিল্লাফাল্লা করে : আবু নিদালী।

 

সেই আমলে একটা গুণীনের দিন ভালই চলে যেত। খাওয়া-পরার রমরমা না থাকলেও অনাহারে থাকতে হত না। নতুন ধান উঠলে গুণীনের বাড়িতে এক ধামা ধান পাঠিয়ে দেয়া রেয়াজের মধ্যে ছিল। লাউগাছে দশটা লাউ ফললে একটা লাউ পাঠিয়ে দেও গুনীনের কাছে।

এইসব সভ্যতা-ভব্যতার আজকাল কিছুই নাই। মন্ত্র-তন্ত্রের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে গেছে। পাগলা কুকুরে কামড় দিলে হলুদ পোড়ার জন্যে তার কাছে আসে না। রোগী নিয়ে সোজা চলে যায় সদরে। নাভির মধ্যে সাত ইনজেকশান। এতে নাকি রোগ আরাম হয়। কি বে-সম্ভব কথা!

চান্দ শাহ ফকিরের দিনকাল বড়ই খারাপ যায়। স্ত্রীর কটু কথা মুখ বুজে শুনতে হয়। অভাব-অনটনে রোগে ব্যাধিতে ফুলবানুর মাথা থাকে চড়া। কড়া কথা যখন বলে কঠিন করেই বলে। আগে হঠাৎ হঠাৎ বলতো, ইদানীং প্রায় রোজই বলছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছাতিম গাছের নিচ থেকে ঘরে ঢুকতে আজকাল চান্দ শাহ ফকির আতংকগ্রস্ত হয়। মনে হয়, না জানি কপালে কি আছে।

 

চান্দ শাহ ফকির রাতে শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়তে পারে না। বয়সের কারণে। তার ঘুম কমে গেছে। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকতেও তার ভাল লাগে না–গল্প করতে ইচ্ছা করে। ফকিরী গল্প। গল্প শুরু করলে ফুলবানু এমন হৈ চৈ শুরু করে। যে চান্দ শাহর আফসোসের সীমা থাকে না কেন সে গল্প শুরু করল! চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকলে এই যন্ত্রণা হত না। একে বলে খাল কেটে কুমীর আনা।

আজ রাতেও এ রকম খাল কাটার ব্যাপার ঘটেছে। চান্দ শাহ ফকির মনের আনন্দে খাল কেটে যাচ্ছে। সে তার এক ফকিরী গলপ শুরু করেছে। গল্প বলতে বড় ভাল লাগছে। সে বুঝতেই পারছে না কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাটা খালে কুমীর আসবে। আলিশান কুমীর।

বুঝলা বউ, তখন আমার যৌবন কাল। তোমার সঙ্গে তখনো বিবাহ হয় নাই। টুকটাক ফকিরি করি। ফকিরের তো আর চব্বিশ ঘণ্টার কাজ না। যখন ডাক পড়ে ফট। বাকি সময় গান-বাজনা করি। যৌবনকালে ঢোল ভাল বাজাইতাম। মন্দিরাও শিখছিলাম। তবে ঢোল হইল মন্দিরার চেয়ে কঠিন বিদ্যা। শুনতেছ বউ?

শুনতেছি। বলেন।

তখন মুরাদপুর গ্রাম থাইক্যা একটা ডাক পাইলাম। মুরাদপুর গ্রামের বিশিষ্ট জোতদার ইয়াজুদ্দীন হাওলাদার মহিষের গাড়ি পাঠায়ে দিয়েছেন আমাকে নিবার জন্যে। কারণ তার পুত্রবধূর প্রসববেদনা। বউ শুনতেছ? বড়ই চমকপ্রদ কাহিনী।

আফনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনতেছি।

হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ হইল মৃতবৎসা। মৃতবৎসা বুঝলা তো–সন্তান হয়, আর বাঁচে না। আমার ডাক পড়ছে বিষয় কি দেখার জন্যে। গিয়া দেখি মেলা ডাক্তার-কবিরাজ আছে, আমিও তাদের মধ্যে শামিল হইলাম। হাওলাদার সাহেব বিরাট সম্মান করলেন। হাত ধইরা অন্দরে নিয়া গেলেন। হাঁক-ডাক শুরু করলেন।

–ফকির সাবেরে পাও ধোয়া, পানি দে, সরবত দে।

জামাই আদর।

এক সময় আমরার কদর ছিল বউ। জামাই আদরই ছিল–গুণীন তো আর পথে-ঘাটে জন্মায় না। দশ গ্রামে বিশ গ্রামে একটা। যাই হোক, গল্পটা শোন। আমি উঠানে বইস্যা দুই ঝাড়া দিয়া পাইলাম–হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ জ্বীনের সাথে একবার বেয়াদবি করছিল।

কি বেয়াদবি?

জ্বীন পুসকুনিতে গোসল কইরা পাকপবিত্র হইয়া আসতেছিল, তখন হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ নাক ঝাড়া দিয়া তার গায়ে নাকের সর্দি ফেলছে। তারপর থাইক্যা। জীন লাগছে তার পিছনে। অল্প বয়সী চেংড়া জ্বীন–নাম হইল কলিন্দর। শাহবাজ। এরার মিজাজ খুবই চড়া থাকে। এই হইল ইতিহাস।

আপনে কি করলেন? জ্বীনের শইলের সর্দি মুইছা দিলেন?

তা না। জ্বীন তাড়াইলাম। দেশছাড়া করলাম।

এক্কেবারে দেশান্তরী?

অবশ্যই। মন্ত্রের তো আমার কাছে অভাব নাই বউ। একটায় কাজ না করলে আরেকটা দেই। কোন কিছুই যখন কাজ করে না তখন আছে কুফুরি কালাম। বড় কঠিন জিনিস। অষুধের মধ্যে যেমন পেনিসিলিন ইনজেকশন–মন্ত্রের মধ্যে তেমন কুফুরি কালাম। পাক কোরানের কালাম উল্টাপাল্টা কইরা পড়তে হয়। বিরাট গুনার কাজ। কিন্তু উপায় কি? গুণীন হইয়া জন্মাইছি গুনা তো করতেই হইবে। রোজ হাশরে এর শক্ত বিচার হবে। আমরা যারা গুণীন আমরার সামনে তোমরা চেলচেলাইয়া বেহেশতে যাইবা। আর আমরা দোজখের আগুনে পুইড়া মরব। এইটাই বিধান।

চান্দ শাহ ফকির তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে গল্প শেষ করে। বারুদের মত জ্বলে উঠে ফুলবানু।

এইসব মিথ্যা কথা বইল্যা আফনে মানুষ ঠকান? আফনের লজ্জা নাই?

ফুলবানু রোগের কথা ভুলে বিছানায় উঠে বসে। চান্দ শাহ ফকির শংকিত বোধ করে। কাটা খাল বেয়ে কুমীর চলে এসেছে। তাও ছোটখাট কুমীর না, বিরাটাকার কুমীর।

দুনিয়ার বেবাক মন্ত্র গুইল্যা খাইছেন? বলতে শরম লাগে না?

চান্দ শাহ ফকির ক্ষীণ গলায় বলল, শরমের কি আছে? শরম নারীর ভূষণ, পুরুষের কলংক।

শরমের কিছু নাই? তা হইলে মন্ত্রের একটা খেলা দেখান দেখি? নিদালী মন্ত্র পইরা একটা ফুঁ দিয়া আমারে ঘুম পাড়াইয়া দেন। না দিলে আইজ অসুবিধা আছে।

রাইত দুপুরে কি চিল্লা ফাল্লা শুরু করলা?

হয় মন্ত্রের খেলা আইজ আফনে দেখাইবেন, নয় গলায় গামছা দিয়া কইবেন মন্ত্রফ কিছু জানি না। যা বলি সবই মিথ্যা।

এইটা যদি স্বীকার পাই তাইলে তো মিথ্যা কথা হয়, মিথ্য বলি ক্যামনে বউ?

ওরে বাবা রে, আমার সত্যবাদী রে!

বুঝলা বউ, মন্ত্র-তন্ত্রের এই বিদ্যা যারা চর্চা করে মিথ্যা বলা তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিষেধ।

ফুলবানু হাসতে শুরু করে। অপ্রকৃতস্থ মানুষের হাসি। হাসতে হাসতে তার হিক্কা উঠে যায়। চান্দ শাহ ফকির বড় অসহায় বোধ করে। মনে মনে বলে–কি যে। যন্ত্রণায় পড়লাম! গল্প শুরু না করলেই হত।

এক শ্রাবণ মাসের মধ্যরাতে ফুলবানুর বুকে তীব্র ব্যথা হল। বিছানায় শুয়ে সে ছটফট করতে লাগল। সমস্ত শরীর তার নীলবর্ণ হয়ে গেল। চান্দ শাহ ফকির স্ত্রীর অবস্থা দেখে অবাক হল। মুখে স্বীকার না করলেও স্ত্রীকে সে অত্যন্ত পছন্দ করে। তার চিৎকার, তার রাগারাগি সবই পছন্দ করে। চান্দ শাহ ফকিরের ইচ্ছা করতে লাগল চিৎকার করে কাঁদে। গুণীনদের জন্যে চোখের পানি ফেলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ বলে চোখের পানি ফেলতে পারছে না। ফুলবানু স্বামীকে ডেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার মৃত্যুর সময় হইছে। আফনেরে একটা অনুরোধ।

চান্দশাহ বলল, বল বউ কি অনুরোধ। তুমি যা বলবা আমি তাই করব। জ্বীন চালান দিয়া অষুধ আইন্যা দিতেছি। একটু সবুর কর। জ্বীনের রাজধানী হইল কোহকাফ নগর। সেই রাজধানী থাইক্যা অষুধ চইল্যা আসবে।–

আবার মিথ্যা?

চান্দ শাহ নিঃশ্বাস ফেলল। আগের মত জোর গলায় বলতে পারল না–সে যা বলছে তা মিথ্যা না। ফুলবানু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মন্ত্র-তন্ত্র নিয়া আর মিথ্যা ভণ্ডামি কইরেন না। আফনের আল্লাহর দোহাই লাগে।

চান্দ শাহ ধরা গলায় বলল, আচ্ছা যাও করব না।

মোবারকরে ডাক দিয়া বলেন, সব মিথ্যা। বোকাসোকা মানুষ, একটা আশার মধ্যে আছে। আপনে তারে অদৃশ্য মন্ত্র দিবেন।

আচ্ছা, তারে বলতেছি।

এখনই বলেন।

এত অস্থির হইও না বউ। শান্ত হও।

শান্ত পরে হব–আগে আপনে তারে বলেন। আমার সামনে আইন্যা বলেন। নিজের কানে শুনি।

চান্দ শাহ মোবারককে ডেকে আনলেন। ধরা গলায় বললেন, মোবারক শোন, মন্ত্রফ আসলে কিছু না। এতদিন তোরে যা বলছি সবই মিথ্যা। বুঝছস?

ছি না।

ফুলবানু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মন্ত্র হইল ধাপ্পাবাজি, বুঝছস? মন্ত্র বইল্যা কিছু নাই। মন্ত্র থাকলে আইজ আমরার এই অবস্থা? খাওন নাই, পিন্দনের কাপড় নাই, রোগে চিকিৎসা নাই। মন্ত্র হইল মিথ্যা।

মন্ত্র মিথ্যা মামী?

হ রে ব্যাটা মিথ্যা। তুই বেহুদা তর মামার পিছে পিছে ঘুরিস না। কাজ কইরা খা।

জি আইচ্ছা।

জ্বি আইচ্ছা না। আইজই বিদায় হ–এক্ষণ যা।

চান্দ শাহ ফকির বিরক্ত গলায় বলল, এক্ষণ যাওয়ার দরকার কি? ধীরে সুস্থে যাইব। ঘরে এমন রোগী, কখন কি দরকার হয়।

ফুলবানু বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, না, হে এক্ষণ যাইব। এক্ষণ। এক্ষণ বিদায় না হইলে আফনে তারেও মন্ত্র শিখাইবেন। হেও হইব আফনের মত ধান্ধাবাজ। তার জীবন কাটব দুঃখে দুঃখে …।

ঠিক আছে, অস্থির হইও না। ব্যবস্থা করতেছি।

ব্যবস্থা করা করি না। মোবারকরে বিদায় করেন। টেকা পয়সা যদি কিছু থাকে মোবারকের হাতে দেন। দিয়া বিদায় করেন।

ফুলবানুকে শান্ত করার জন্যে সেই রাতেই মোবারককে বিদায় করতে হল। ফুলবানুর অস্থিরতা তাতে কমল না। আরো বেড়ে গেল। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। তার কষ্ট চোখে দেখা যায় না। চান্দ শাহ ফকিরের চোখে পানি এসে গেল। সে গুণীন মানুষ। গুণীন মানুষের চোখে পানি আসা ভয়ংকর ব্যাপার। মন্ত্রের জোর বলে কিছু থাকে না। কিন্তু সে চোখের পানি সামলাতে পারছে না।

ফুলবানু স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, কানতেছেন ক্যান? পুলাপানের মত চিক্কর দিয়া কান্দন। ছিঃ ছিঃ! মানুষ হইয়া জন্মাইছি, রোগ হইব। ব্যাধি হইব–একদিন মরণ হইব। কান্দনের কি? চউখ মুছেন।

চান্দ শাহ চোখ মুছল। সেই চোখ সঙ্গে সঙ্গে জলে ভর্তি হয়ে গেল। ফুলবানু অতি কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে বলল, আফনে আমার সামনে থাইক্যা যান। আমার সামনে বইস্যা আফনের কষ্ট হইতেছে।

কই যাব?

ছাতিম গাছের তলে গিয়ে বসেন।

কি যে তোমার কথা!

আমার কথা ঠিক আছে। আপনে যান কইলাম–এক্ষণ যান। শইলডা একটু ভাল বোধ হইলে ডাক দিব।

বউ। আবার কথা?

চান্দ শাহ ফকির হুঁকা হাতে ছাতিম গাছের নিচে বসল। কৃষ্ণপক্ষের মরা চাদ উঠেছে। চারদিকে গা ছমছমা আলো। ঘরের ভেতর থেকে ফুলবানুর কাতরানি শোনা যাচ্ছে। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। চান্দ শাহ ফকিরকে চমকে দিয়ে কে একজন মিষ্টি গলায় ডাকল–ফকির সাব। চান্দ শাহ চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভয়ে সে অস্থির হয়ে গেল। ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। কোত্থেকে আসছে এত মিষ্টি সুবাস?

কে, কে? কে কথা বলে?

মিষ্টি গলা আবার শোনা গেল–এওমা, ভয়ে আপনি দেখি আমরা। যে দিন-রাত জ্বীন-সাধনা, পরী সাধনার কথা বলে তার এমন ভয় পেলে চলে?

আপনে কে?

আমি পরী।

চান্দ শাহ হতভম গলায় বলল, পরী বইল্যা দুনিয়ায় কিছু নাই।

ওমা, আজ দেখি উল্টা কথা।

উল্টা না, এইটা সত্য।

এইটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার কথা কিভাবে শুনছেন?

রোগে-শোকে, অভাবে-অনটনে মনের মধ্যে ধান্ধা লাগছে। ধান্ধার কারণে কথা শুনতেছি। আসলে কিছু না।

ভাল করে তাকান। তাকিয়ে দেখেন তো কি ব্যাপার।

চান্দ শাহ ফকির ভাল করে তাকালো। আরে তাই তো, তার সামনে একটা পরীই তো দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে কিশোরী মেয়েদের মত। শুধু চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। পাখা আছে–পাখা দুটা অল্প অল্প কাঁপছে। ফুলের গন্ধ আসছে পরী মেয়েটার গা থেকে। কি অদ্ভুত গন্ধ আর কি সুন্দর মেয়েটার মুখ! পরী ঠোট টিপে হাসতে হাসতে বলল, দেখলেন?

চান্দ শাহ কিছু বলল না। বলবে কি? সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। পরী আবার কি?–কি, মুখে দেখি বাক্য নেই। বিনা আগুনে হুক্কা টানছেন। হুক্কায় আগুন দেয়ার কেউ নেই। মোবারক চলে গেছে?

জি।

ঘরে এমন রোগী, জীবন-মরণ ব্যাপার। আর মোবারক চলে গেল?

চান্দ শাহ কি বলবে ভেবে পেল না। শরীর বন্ধন মন্ত্রটা কি পড়বে? পড়ে ফেলা দরকার। এই পরী মেয়েটার কাণ্ডকারখানা ভাল ঠেকছে না। যদিও মন্ত্র-তন্ত্র বলে। কিছু নেই। নেই-ই বা বলা যায় কি ভাবে? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে পাখাওয়ালা পরী। কি আজিব কাণ্ড!

চান্দ শাহ ফকির।

চান্দ শাহ জবাব দিল না। শরীর বন্ধন মন্ত্র মনে করার চেষ্টা করতে লাগল–

দোহাই দোহাই
তিন পীর।
কিরপিন সবে নীর।।
লক্ষ্মী ও মনসা।
মা কালী ভরসা।
দিলাম দেহ বন্ধন
রক্ত বর্ণ চন্দন।।
ফুলের নাম জবা।
পশ্চিমে রয় কাবা।
কাবার ঘরে ছয় কুঠুরী …

পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। চান্দ শাহ ফকিরের মন্ত্রে গণ্ডগোল হয়ে গেল। দেহ বন্ধন মন্ত্র দীর্ঘ মন্ত্র। একবার আউলা লেগে গেলে গোড়া থেকে পড়তে হবে।

চান্দ শাহ ফকির বিড়বিড় করে কি পড়ছেন? মন্ত্র?

জ্বি।

কি মন্ত্র? দেহ বন্ধন?

হুঁ।

মন্ত্র-তন্ত্র বলে কিছু আছে?

জ্বি না।

তাহলে পড়ছেন কেন?

আপনে কে?

একবার তো বললাম। আবার বলতে হবে? আমি পরী।

ও আচ্ছা।

আমি আপনার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, আপনার চোখের পানি দেখে নেমে এলাম। কাদছিলেন কেন?

চান্দ শাহ চুপ করে রইল। বলবেই বা কি? বলার মত কোন কথা কি আর আছে।

শুনুন চান্দ শাহ, আমার হাতে একেবারে সময় নেই। আমি এক্ষুণি চলে যাব। তবে নেমেছি যখন, তখন আপনার একটা ইচ্ছা পূরণ করব। বলুন কি চান? যা চান তাই পাবেন। তবে একটা মাত্র জিনিশ। বলে ফেলুন? এক কলসী সোনার মোহর দিলে হবে? এক কলসীর জায়গায় সাত কলসীও দিতে পারি। তবে ধনদৌলত বেশি হলেও সমস্যা হয়। দেব এক কলসী মোহর?

জ্বি না।

ধনদৌলত চান না। তাহলে কি চান? সম্মান? লোকজন আপনাকে দেখেই সালাম করবে। যত বড় মানুষই হোক, আপনাকে দেখে উঠে দাঁড়াবে?

জি না।

বাকি রইল কি–ক্ষমতা। ক্ষমতাও খুব ভাল জিনিশ। ধনদৌলত, সম্মানের চেয়ে ক্ষমতা অনেক মধুর–ক্ষমতা চান?

জ্বি না। আপনে ফুলবানুরে ভাল কইরা দেন।

উদ্ভট কথা বলেন কি ভাবে। ফুলবানুরে আমি ভাল করব কি ভাবে? আমি কি ডাক্তার–মেডিকেল কলেজের ডিগ্রী আছে আমার? আপনাকে বুদ্ধিমান লোক বলে ভেবেছিলাম–এখন তো দেখছি আপনি বোকা। মহা বোকা। ফুলবানু যে দজ্জাল, ভাল হয়ে গেলে আপনকে তো কচলে ফেলবে।

কচলাইলেও ক্ষতি নাই।

কচলালেও ক্ষতি নেই? তাহলে তো ভাল করে দিতেই হয়। আচ্ছা ঠিক আছে দিচ্ছি ভাল করে। যান, ঘরে যান, ঘরে গিয়ে দেখুন। আর আমি বিদায় হচ্ছি।

পাখির ডানা ঝাপ্টানোর মত শব্দ হল। হতভম্ব চান্দ শাহ ফকিরের চোখের সামনে পরী আকাশে উঠে গেল। পরী চলে গেলেও তার গায়ের গন্ধ এখনো রয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে ফুলবানু ডাকল–এই যে ফকির সাব, শুইন্যা যান।

চান্দ শাহ ঘরে ঢুকে দেখে ফুলবানু খাটে বসে আছে। তার মুখটা হাসি হাসি। চান্দ শাহকে দেখে সে খানিকটা লজ্জা মাখা গলায় বলল, বুকের ব্যথাটা হঠাৎ কইরা চইল্যা গেছে।

বল কি?

শইলটাও ভাল ঠেকতেছে।

হুঁ।

দেখেন না নিজে নিজে উইঠ্যা বসছি।

হুঁ।

পিয়াস লাগছে। এক গ্লাস পানি দেন তো।

চান্দ শাহ অতি দ্রুত পানি নিয়ে এল। ফুলবানু তৃপ্তির সঙ্গে গ্লাস শেষ করে বলল, হঠাৎ শরীরটা এমন ভাল ঠেকতেছে কেন কিছুই বুঝলাম না।

চান্দ শাহ বলল, ঘটনা তোমারে বলি। বড়ই চমকপ্রদ ইতিহাস। হইছে কি–ছাতিম গাছের নিচে বইসা ছিলাম, হঠাৎ দেখি চোখের সামনে এক পরী। বড় সৌন্দর্য চেহারা। বড় বিউটি।

চোখের সামনে কি দেখলেন? পরী? হুঁ, পরী। আবার শুরু করছেন? আবার?

চান্দ শাহ চুপ করে গেল। এমন সুন্দর একটা গন্ধ। এমন এক চমকপ্রদ ইতিহাস। কিন্তু সে তার স্ত্রীকে বলতে পারবে না। কোনদিনই বলতে পারবে না। এরচে দুঃখের ব্যাপার আর কিই বা হতে পারে!

ফুলবানু খাট থেকে নেমেছে। সে হেঁটে হেঁটে দরজা পর্যন্ত গেল। তার বিস্ময়ের সীমা নেই–দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সে নিজে হেঁটে দরজা পর্যন্ত গিয়েছে।

ফুলবানু দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণপক্ষের মরা জোছনাও তার কাছে। অপূর্ব লাগছে। ফুলবানু মুগ্ধ গলায় বলল, জংলা কি ফুল জানি ফুটছে। কি গন্ধ!

ফুলের গন্ধের রহস্যের চমকপ্রদ ইতিহাস চান্দ শাহ ফকির জানে, কিন্তু তার বলার উপায় নেই। সেও এসে স্ত্রীর পাশে দাঁড়াল।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x